মিউনিখ হত্যাকান্ড এর ইতিহাস 

মিউনিখ হত্যাকান্ড এর  ইতিহাস 

বিশ্বে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে অলিম্পিক গেমসের এক ঐতিহ্যবাহী ধারা প্রবাহমান। বহু খ্যাতনামা অ্যাথলিট, দৌড়বিদ, সাঁতারু কিংবা শ্যুটারকে বিশ্ব চিনেছে এই প্রতিযোগিতা থেকেই। কিন্তু এই অলিম্পিকেই ঘটেছিল এক বিধ্বংসী হত্যাকাণ্ড। ১৯৭২ সালে Munich massacre জার্মানির মিউনিখে আয়োজিত অলিম্পিকে হঠাৎই এক প্যালেস্তাইনের গুপ্তঘাতক সংগঠন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ ঢুকে পড়ে গেমস ভিলেজে আর এগারোজন ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানকে অপহরণ করে নেয়।

ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির দাবিতে তারা ঐ অলিম্পিয়ানদের অপহরণ করেছিল বলে জানা যায়। দুজন ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানের মৃত্যু হয় আর পুলিশি সংঘর্ষে নয়জন গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী মারা যায়। এই ঘটনাই বিশ্বের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের অলিম্পিকের পাশাপাশি মিউনিখ হত্যাকান্ড  নামে পরিচিত। চলুন জেনে নেওয়া যাক আসলে কী ঘটেছিল ঐদিন।

হিটলারের নাৎসি বাহিনীর প্রতাপে এবং চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্রের চাপে ১৯৩৬ সালের পর আর অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি জার্মানিতে। দীর্ঘ ৩৬ বছর পরে ১৯৭২ সালে হিটলার-জমানার অবসান ঘটলে জার্মানির মিউনিখে ২৬ আগস্ট শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজিত হয় অলিম্পিক। মোট একশো পঁচানব্বইটি ইভেন্টে একশো একুশটি দেশ থেকে মোট সাত হাজার একশো তিয়াত্তর জন প্রতিযোগীকে নিয়ে শুরু হয় মিউনিখ অলিম্পিক। প্রথম দশদিন ভালোভাবে চললেও ৫ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে অলিম্পিকের গেমস ভিলেজে ঢুকে পড়ে প্যালেস্তাইনের বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী সংগঠন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এর উগ্রপন্থীরা এবং অলিম্পিকে যোগদানকারী এগারো জন ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানকে বন্দি করে।

তাদের সঙ্গে ছিল কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল, গ্রেনেড এবং ডাফেল ব্যাগে রাখা ছিল টোকারেভ পিস্তল। অস্ত্রসমেত গেমস ভিলেজের ৩১ নং কনোলিরাসসি নামের বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ে কালো ট্র্যাকসুট আর কালো মুখোশ পরিহিত সেইসব উগ্রপন্থীরা। তারা যে সশস্ত্র এবং যে কোনো মুহূর্তে ক্ষতি করতে পারে সেই প্রমাণ দিতে ঐ বিল্ডিংয়ে থাকা কুস্তির প্রশিক্ষক মশে ওয়েইনারের মৃতদেহ সামনের দরজা থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল উগ্রপন্থীরা। তাদের দাবি ছিল ইজরায়েলের কারাগারে বন্দি দুশো চৌত্রিশ জন ফিলিস্তিনি এবং জার্মানির কারাগারে বন্দি দুজন নব্য নাৎসি নেতা অ্যান্ড্রিয়াস ব্যাডের এবং উলরাইখ মেইন্‌হফের মুক্তি। বলাই বাহুল্য এই আক্রমণে মদত দিয়েছিল জার্মানির নব্য নাৎসি দল ‘ফ্যাকশন রেড আর্মি’।

ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তখন গোল্ড মেয়ার। কিছুতেই তিনি এই অবৈধ প্রস্তাব মেনে নিতে চাননি। প্যালেস্তাইনের এক আধা-সামরিক সংগঠন এই ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এর উৎপত্তি হয় ১৯৭০ সালে। আরবি ভাষায় এই দলটি ‘মুয়াজ্জামাত আইয়ুল আস-ওয়াদ’ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্যালেস্তানীয়-খ্রিস্টান দুটি গ্রাম ইক্‌রিত এবং বিরামের বাসিন্দাদের উৎখাত করেছিল। জানা যায় এই উদ্বাস্তুরাই একজোট হয়ে গড়ে তোলে এই ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন লুতিফ আতিফ। এই আক্রমণের সময় দুজন ইজরায়েলি অলিম্পিয়ান বাধা দিতে গেলে সেই স্থানেই তারা খুন হন।

টানা আঠারো ঘন্টা সেই গুপ্ত বাহিনী গেমস ভিলেজেই অবস্থান করে। ইতিমধ্যে জার্মানি এবং ইজরায়েল সরকারের মধ্যে আলোচনা চলে। জার্মান পুলিশ এরপর পরিকল্পনা করে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ যে তাঁদের বন্দিদের হেলিকপ্টারে করে প্যালেস্তাইনে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়েছে তাকে সমর্থন করবে এবং সেইমতো হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়ার সময়েই গুলি চালানো হবে সন্ত্রাসবাদীদের উপর। ফলে জিম্মিকারীদের চাহিদা অনুযায়ী দুটো হেলিকপ্টার পাঠানো হয় এবং গেমস ভিলেজ থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ফাস্টেনফ্রেডবুক বিমানবন্দরে জার্মান পুলিশ নয়জন বন্দি সহ ঐ উগ্রপন্থীদের হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য সহায়তা করে নিয়ে যায়।

ঐ বিমানবন্দরেই লুকিয়ে ছিল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। জার্মান পুলিশের কাছে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র থাকলেও সেখানে তারা সেগুলি যথাযথভাবে নিয়ে যায়নি। বিমান-সেবকের ছদ্মবেশে সতেরো জন দক্ষ পুলিশ আগে থেকেই ওখানে উপস্থিত ছিল। পরিকল্পনা ছিল যে সন্ত্রাসবাদীরা হেলিকপ্টারে উঠলেই আক্রমণ করা হবে তাদের, কিন্তু শেষে সেই পরিকল্পনা বদলে নেয় পুলিশ। রাতের অন্ধকারে ধীরে ধীরে নয়জন অ্যাথলিটকে উদ্ধার করে গাড়িতে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে দেশে ফেরানোর পরিকল্পনা করলেও রাত দশটার সময় কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী হেলিকপ্টার পরীক্ষা করতে নামলে তখনই পুলিশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত শুরু হয়।

প্রবল গুলিবর্ষণে বেশিরভাগ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য এবং একজন পুলিশ মারা যান। এরপর পরিকল্পনা বুঝতে পেরে সন্ত্রাসবাদীরা বন্দিদের হেলিকপ্টারকে তাক করে গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়। ফলে প্রবল বিস্ফোরণে সকল অ্যাথলিট মারা যায়, কাউকেই আর উদ্ধার করা যায়নি। ইজরায়েলি অ্যাথলিটদের উদ্ধারের জন্য আসার কথা ছিল কয়েকটি গাড়ির যেগুলি যানজটে আটকে পড়ায় অকুস্থলে পৌঁছাতে পারেনি ঠিক সময়ে। এই গোলাগুলির মধ্যেও তিনজন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য বেঁচে গিয়েছিল যাদের নাম যথাক্রমে আদনান-আল-গ্যাসি, জামাল-আল-গ্যাসি এবং মহম্মদ সাফাদি। ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে এই এগারো জন ইজরায়েলি প্রতিযোগীর মৃত্যু বিশ্বের ইতিহাসে চরম ন্যক্কারজনক একটি অধ্যায়।

এই ঘটনায় তিনজন সন্ত্রাসবাদী যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের বিচার চলে এবং যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ড দেওয়া হয় তাদের। পরবর্তীতে জার্মানির ‘লুফথান্‌সা ফ্লাইট ৬১৫’ বিমানটি হাইজ্যাক করে সেই ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এর কয়েকজন সদস্য আর তার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে ওই দুজন বন্দি সন্ত্রাসবাদীকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় পশ্চিম জার্মানি সরকার। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি অ্যাভ্রে ব্রুণ্ডেজ প্রতিযোগিতা চালু রাখার নির্দেশ দেন। টানা একদিন স্থগিত থাকলেও পরে কড়া নিরাপত্তার বাঁধনে পুনরায় অলিম্পিক শুরু হয়।

এই অলিম্পিকেই আমেরিকান সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ সাতটি স্বর্ণপদক অর্জন করেন এবং কিশোরী রাশিয়ান জিমন্যাস্ট ওলগা কোরবাট দুটি স্বর্ণপদক লাভ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনায় ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেয়ার চুপ থাকেননি। মিউনিখ হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পরে ইজরায়েল সরকার ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’-এর দশটি গুপ্ত ঘাঁটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস করে দেয়। গোল্ড মেয়ার ঘোষণা করে দেন যে ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানদের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চরম শাস্তি দেওয়া হবে।

ইজরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী ‘মোসাদ’কে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তাদের হত্যা করার। একটি কমিটিও গঠন করে ইজরায়েলি সরকার যার কাজ ছিল খুঁজে খুঁজে গুপ্তহত্যার জন্য সন্ত্রাসবাদীদের খুঁজে বের করা। জানা যায় এই কমিটি মোট কুড়ি-পঁচিশ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। মোসাদ বাহিনীর এই গুপ্ত অভিযানের নাম ‘অপারেশন র‍থ অফ গড’ (Operation Wrath of God)। ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর এই বাহিনী অপারেশনের প্রথম গণহত্যা ঘটায় ফিলিস্তিনি ওয়ারিল রোমে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হিসেবে মাহমুদ হামশারি নামে এক স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীকে হত্যা করে মোসাদ বাহিনী।

এই মিউনিখ হত্যাকান্ড কে অবলম্বন করে নির্মিত হয় ‘ওয়ান ডে ইন সেপ্টেম্বর’ নামে অস্কারজয়ী একটি তথ্যচিত্র এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ২০০৫ সালে নির্মাণ করেন বিখ্যাত ‘মিউনিখ’ নামের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। এই ঘটনার চার বছর পরে ১৯৭৬ সালে মন্ট্রিলে আয়োজিত অলিম্পিকে ইজরায়েলি অলিম্পিয়ানরা মৃত এগারো জন অ্যাথলিটদের স্মরণ করে দেশের পতাকায় কালো রিবন যুক্ত করে রাখে।

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মিউনিখ হত্যাকান্ড -এ নিহত ইজরায়েলি খেলোয়াড়দের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতি সদন তৈরি করা হয় অলিম্পিক গেমস ভিলেজে। ২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঐ নিহত খেলোয়াড়দের পরিজনবর্গের আবেদনে সাড়া দিয়ে অলিম্পিক কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে ইজরায়েলি খেলোয়াড়দের দল মিউনিখ হত্যাকান্ড – নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করে।  

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা