ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদে আজও পূজিত হন হিন্দু রাজা

ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদে আজও পূজিত হন হিন্দু রাজা

হিন্দু রাজার পুজো হয় মুসলমানদের মসজিদে!‌ জানেন কোথায়?‌ এই ঘটনা শুনতে রূপকথার মনে হলেও বাস্তব কিন্তু এটাই। মহানবী হজরত মহম্মদের জীবদ্দশাতেই সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অনেকটা নিভৃতে ইসলাম প্রবেশ করে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। আর সেখানেই নির্মিত হয় ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ চেরামন জুমা মসজিদ। এটি শুধু ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদই না, আরব বিশ্বের বাইরে নির্মিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি।

ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগরের উপকূলে, বর্তমান কেরল রাজ্যে এক হিন্দু রাজা ছিলেন। যার নাম ছিল চেরামন পেরুমল। কথিত আছে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, আকাশের চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা তার সভার বিদ্ব্যজ্জনদের কাছ থেকে স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইলে কেউ সদুত্তর দিতে পারেনি। রাজার মনে অস্বস্তি থেকেই যায়। তখন ভারতের সঙ্গে আরবের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল। আরব দেশীয় বণিকরা সমুদ্রপথে ভারতে এসে বাণিজ্য করত।

রাজার স্বপ্নের কিছুদিন পরেই একদল আরব মুসলমান বণিক, রাজা চেরামনের সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছয়। এই বণিকদের কাছ থেকে রাজ্যে এই নতুন ধর্ম ইসলাম এবং নবী হজরত মহম্মদের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একটা সময় মহানবীর আঙুলের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার কাহিনীও রাজার কানে আসে। রাজা বণিকদেরকে ডেকে তাদের কথা শোনেন এবং বুঝতে পারেন যে, তার স্বপ্নে তিনি এই ঘটনাটিরই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তখন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বণিকদলের সঙ্গে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

সেখানে তিনি হজরত মহম্মদের সঙ্গেও সাক্ষাত্‍ করেন এবং 'তাজউদ্দিন' নাম গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে ভারতে ফেরার আগেই যাত্রাপথে ওমানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার আরব সঙ্গীদেরকে ভারতে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য অনুরোধ করেন। এমনকী তাদের হাতে তার রাজ্যের সভাসদদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি তুলে দেন। সেই চিঠিতে তিনি নিজের রাজ্যে একটি মসজিদ স্থাপনের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। বণিকদল রাজার চিঠি নিয়ে আবারও কেরলে আসে। রাজার নির্দেশ অনুযায়ী তারা ৬২৯ সালে ভারতের বুকে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করে।

রাজা চেরামনের নাম অনুসারে মসজিদের নাম রাখা হয় চেরামন জুমা মসজিদ। স্থানীয় স্থাপত্য অনুযায়ী তৈরি এই মসজিদটি দেখতে অনেকটাই হিন্দুদের মন্দিরের মতো। কেরলের স্থানীয় ইতিহাসবিদ রাজন গুরুক্কল মনে করেন, মসজিদটি হয়তো একাদশ অথবা দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। মসজিদের ভেতরে অবস্থিত একটি ফলকে মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ৬২৯ সাল লেখা আছে।

ইতিহাসবিদরা মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারলেও, মুসলমান বণিকরা যে কাছাকাছি সময়ে ওই অঞ্চলে এসেছিল সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। প্রাচীন মিশরীয় এবং সিরিয়ানরা অনেকেই এই অবসরকালীন সময়ে নিজেদের প্রার্থনার জন্য উপাসনালয়ও গড়ে তুলেছিলেন। এই অঞ্চলে তাই পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান সব ধর্মের উপাসানালয়ই দেখতে পাওয়া যায়। জানা গিয়েছে, মসজিদটির ভেতরে একটি প্রাচীন তেল প্রদীপ আছে যেটি সবসময় জ্বলে আছে।

এটি প্রায় ১০০০ বছর ধরে জ্বলছে। শুধু মুসলমান না অন্যান্য ধর্মের পুণ্যার্থীরাও এই প্রদীপের জন্য তেল সরবরাহ করে। কেরলের অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ের মতো এই মসজিদটিও সকল ধর্মবিশ্বাসীদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত। কেরলের এই মসজিদটিতে দিনের কিছু কিছু সময় হিন্দুরাও প্রার্থনা করে থাকেন। ভারত সরকার রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় এই মসজিদটি-স আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে যে প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে, তা পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে।

মোট ২৭টি জাদুঘর রয়েছে। পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম এরকম ৫০টি আকর্ষণীয় স্থান এবং প্রাচীন রোমান সভ্যতার নিদর্শন সম্বলিত একটা খননকৃত এলাকা এটি। এই প্রকল্পটি ২০০৯ সালে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। চেরামন মসজিদ কর্তৃপক্ষও এই প্রকল্পের সঙ্গে মিল রেখে মসজিদটিকে সর্বশেষ সংস্কারে যেতে আগ্রহী, যাতে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি পঞ্চদশ শতকের রূপ পায়।‌