হাওড়ার হাজার হাত মা কালীর ইতিহাস

হাওড়ার হাজার হাত মা কালীর ইতিহাস

  হাওড়ার শিবপুরের ওলাবিবিতলায় হাজার হাতের এই কালীমন্দির প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ ভারতেও এই কালীমূর্তির মহিমা কিন্তু কম নয়।  শোনা যায়, ১৮৮০-তে শুরু হয় এই মন্দির।  কলকাতার চোরবাগানের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই মন্দির গড়ে ওঠে। লোকে তাঁকে তান্ত্রিক আশুতোষ তর্করত্ন নামেও চেনেন। আশুতোষ দেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বেড়াতেন।

পুজোপাঠ, ধ্যান, সাধনা নিয়ে থাকতেন তিনি। এক বার স্বপ্নে কালীর এই হাজার-হাতের রূপ দেখতে পান আশুতোষ। ওলাবিবিতলায় যেখানে আজ এই মন্দির গড়ে উঠেছে সেই জায়গাটিরও স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নাদেশ মতো মন্দির গড়ার জন্য ১২৫ টাকায় হালদার পরিবারের কাছ থেকে ৩ কাঠা জায়গা কিনে মাটির মন্দির তৈরি করেন আশুতোষ। ১৮৭০ সালে সেই মন্দির গড়ে ওঠে।

এখানে দেবী নীলবর্ণা। তাঁর জিভ বাইরে বের করা থাকে না। তাঁর বাহন সিংহ। বিশালাকার সেই দেবী মূর্তির এক হাজার হাত বর্তমান দেবীর বাম পা অবস্থান করছে সিংহের ওপর। ডান পা রয়েছে পদ্মের উপরে।  হাওড়ার ওলাবিবিতলার এই মন্দিরে দেবী মূর্তিটি তৈরি হয়েছে চুন-সুরকি দিয়ে। প্রথমে ৯৯৮টি হাত দেওয়ালে আঁকা ছিল। পরে সেগুলি মাটি দিয়ে তৈরি করেন কুমোরটুলির শিল্পী প্রিয়নাথ পাল। পরে অবশ্য সেগুলিকেও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।  শোনা যায়, এখানে মায়ের হাজার হাত গোনা যায় না। মায়ের অস্ত্র ও মুকুট তৈরি হয়েছে ১১-১২ কেজি রুপোয়। দেবীর মাথায় যে ছাতাটি রয়েছে সেটিও রুপোর তৈরি। 

কুমোরটুলির প্রিয়নাথ পাল বিগ্রহ বানান। চণ্ডীপুরাণ অনুযায়ী, অসুর বধের সময়ে দেবী দুর্গা অনেক রূপ ধারণ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম তাঁর হাজার-হাতের রূপ। চণ্ডীপুরাণের সেই বর্ণনা মতো হাজার-হাতের কালী মূর্তি তৈরি করা হয়। প্রথমে মাটির মন্দির তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সেটাও তৈরির সামর্থ ছিল না আশুতোষের। এক সময় মন্দির নির্মাণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন স্থানীয় হালদার পরিবার এবং স্থানীয়েরা। মাটির প্রতিমা তৈরি করে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা হয় হাজার-হাত কালীমন্দির।  

মন্দির নাকি এক বার ভেঙেও দেওয়া হয়। ফের মন্দির গড়ে তোলেন আশুতোষ। অনেক চেষ্টা করে পাকা মন্দির এবং সিমেন্টের প্রতিমা তৈরি হয়। বিশালাকার এই দেবী নীলবর্ণা। সিংহের উপরে ডান পা তুলে দাঁড়িয়ে দেবী। এখনও বংশানুক্রমে এই মন্দিরের সেবাইত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যরাই। বলির প্রথা নেই এই মন্দিরে।  শোনা যায়, প্রায় ৬০ বছর আগে শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের এক শুক্রবার দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা কৃষ্ণা সুব্রহ্মণ্যম এই মন্দিরে এসেছিলেন। তখন তিনি দৃষ্টিহীন।

হাজার-হাত কালীর কাছে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা করেন। এক বছরের মধ্যে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। তার পর থেকে তিনি মায়ের মাহাত্ম্য প্রচার শুরু করেন দক্ষিণ ভারত জুড়ে। এখন প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় শ্রাবণে শুক্লপক্ষের শুক্রবারে পুজো দেন। এই মন্দিরে প্রতি দিন সকাল সাড়ে ৬টা, দুপুর ২টো এবং রাত সাড়ে ৮টায় পুজো হয়। রাতের আরতির পর প্রসাদ বিতরণ হয়। মায়ের নৈবেদ্যতে প্রতিদিন থাকে মাছ, ভাত, বিভিন্ন রকম ফল ও মিষ্টি। ভক্তদের দেওয়া প্রণামিতে মায়ের সেবা হয়।

নিত্যপুজোর পাশাপাশি বুদ্ধ পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠা দিবসে এবং কালীপুজোর দিন বিশেষ হয় উৎসব। স্থানীয়দের মতে, হাজার-হাত কালী খুবই জাগ্রত, ভক্তিভরে কেউ কিছু চাইলে কালী কাউকে ফিরিয়ে দেন না।  বর্তমানে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশধরেরাই এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবায়েতের কাজ করে আসছে। এই কালীমন্দিরে কোন বলির প্রথা নেই। বছরের দুটি দিন অর্থাৎ বুদ্ধপূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠা দিবস ও কালীপুজোর দিন এই মন্দিরে জাঁকজমকভাবে পালিত হয় মায়ের পুজো। পাশাপাশি শ্রাবণ মাসের শুক্রবারে বহু দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদেরও সমাগম হয় এই হাজার হাত কালী মন্দিরে।