খড়গেশ্বর শিবের নাম থেকেই আজকের আধুনিক শহর খড়গপুর

খড়গেশ্বর শিবের নাম থেকেই আজকের আধুনিক শহর  খড়গপুর

দক্ষিণ-পূর্ব রেলের গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন হল খড়গপুর। হাওড়া থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে এই শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত রেলস্টেশন ও রেলের কারখানাকে কেন্দ্র করে। পূর্বের বি এন আর বা বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের সময় থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর বৃহত্তম প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্যে অন্যতম।

এছাড়া বর্তমানে বেশ কিছু বড় কারখানা এবং আই আই টি-র জন্য খড়গপুর বিখ্যাত হয়েছে। ইন্দা-র বিখ্যাত খড়গেশ্বর শিবের নাম থেকেই শহরের নাম খড়গপুর হয়েছে। এই শহরের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, বাংলার পর এখানে দ্বিতীয় ভাষা তেলেগু। এই শহরকে ঘিরে ভ্রমণ করলে ভ্রমণটা বেশ আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। ইন্দা : খড়গপুর শহরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত ইন্দা।

স্টেশন থেকে ২ কিলোমিটার দূরে এই ইন্দাতে রয়েছে খড়গেশ্বর মহাদেব মন্দির। অনেকের ধারণা, এই দেবতার নাম থেকেই এই শহরের নাম হয়েছে খড়গপুর। যে কোনও জায়গার নামকরণ নিয়ে মতভেদ থাকেই। এ ব্যাপারে খড়গপুরও ব্যতিক্রম নয়। কারণ, কারও কারও মতে, কলাইকুণ্ডা গ্রামের ধারেন্দার রাজা খড়গ সিংহ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বিষ্ণুপুরের রাজা খড়গমল্ল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। চারিদিকে বাড়িঘরের মাঝখানে এক প্রাচীরবেষ্টিত প্রাঙ্গণের মাঝে মন্দিরের অবস্থান।

মন্দিরটি ২০০ বছরের পুরনো হলেও সম্প্রতি বেশ সংস্কার করা হয়েছে, ফলে প্রাচীনত্বের ছাপ খুব একটা নেই। মন্দিরটি পূর্বমুখী, জগমোহনযুক্ত, সপ্তরথ শিখর দেউল। মাঝারি উচ্চতার মন্দিরটির স্থাপত্যরীতিতে উত্‍কলীয় প্রভাব রয়েছে। সামনে রয়েছে বহু পুরনো বিরাট অশ্বত্থ গাছ। গাছের গোড়া আধুনিক টালি দিয়ে বাঁধানো। চারপাশে প্রচুর পাথরের নন্দী ও ত্রিশূলের ছড়াছড়ি, হয়তো মানসিকের স্মৃতি। এতটাই সিঁদুরচর্চিত যে পাথরের দ্বারপালকে আর চেনার উপায় নেই। ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশীতে এবং চৈত্রসংক্রান্তিতে মহা ধূমধামের সঙ্গে পূজা হয়।

খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামান্য দূরে হিড়িম্বেশ্বরী দেবীর মন্দির। ইনি নাকি মহাভারতের হিড়িম্বা রাক্ষসীর আরাধ্য দেবী। সমতল ছাদবিশিষ্ট মন্দিরটি ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। জনশ্রুতি যে, দেবীর আদি মন্দির কালাপাহাড় কর্তৃক নষ্ট হলেও দেবী কিন্তু আত্মগোপন করে নিজেকে রক্ষা করেন। বর্তমান পুরোহিতের পূর্বপুরুষরা দেবীকে উদ্ধার করে নিজ গৃহে পুজো শুরু করেন।

পরে স্থানীয় মানুষদের অনুগ্রহে বর্তমান গৃহটি নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে অষ্টধাতুর নির্মিত চতুর্ভুজ ছোট দেবী মূর্তি। মূর্তির মাথায় জটার মতো একটি স্তূপ রয়েছে। মূর্তিটি এমনভাবে সিঁদুরলেপা যে মূল আকৃতি বোঝা যায় না। পূজারিদের মতে, মূর্তিটি কালীর এবং তাই দেবীকে দক্ষিণাকালীর ধ্যানে পূজা করা হয়। এছাড়াও সিঁদুররঞ্জিত আর একটি বিকটদর্শন মুখমণ্ডল রয়েছে যিনি শীতলা হিসেবে পূজিত হন। দেবীর নিত্যপূজা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে বাত্‍সরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই দিন বহু মানুষের সমাগম হলেও নারীর সংখ্যাই বেশি যাঁরা মানসিক শোধ করতে দেবীকে পূজা দিতে আসেন চাল, ডাল, ফলমূল, দুধ, মধু ইত্যাদি দিয়ে। নানারকম বিপদ থেকে তিনি ত্রাণ করেন বলেই মানুষের বিশ্বাস। বন্ধ্যাত্বমোচনের ঔষধ মন্দির থেকে দেওয়ার রীতি আছে। দেবীমন্দির সংলগ্ন প্রান্তরটি 'হিড়িম্বাডাঙা' নামে পরিচিত। কথিত আছে, বনবাসকালে পঞ্চপাণ্ডবরা একদিন এখানে আসেন।

এ অঞ্চল তখন হিড়িম্বা রাক্ষসের অধিকারভুক্ত। হিড়িম্বের বোন হিড়িম্বা ভীমের প্রেমে পড়ায় ক্রুদ্ধ হিড়িম্ব ভীমকে আক্রমণ করে মেরে ফেলতে চায়। ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বের ঘোরতর যুদ্ধ হয় এই প্রান্তরে। যুদ্ধে হিড়িম্ব পরাজিত ও নিহত হয়। বহুকাল ধরে লোকে বিশ্বাস করে আসছে এই প্রান্তর বা ডাঙাতেই ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বের মল্লযুদ্ধ হয়েছিল। তাই এ স্থান হিড়িম্বাডাঙা নামে পরিচিত।

মহাদেব মন্দিরের একটু দূরে রয়েছে পির লোহানি সাহেব নামের এক মুসলমান ফকিরের সমাধি। ফকিরের আসল নাম সৈয়দ শামিরু খান লোহানি মতান্তরে আমির খাঁ। মনে করা হয়, যেহেতু তিনি লোহানি বংশের ছিলেন তাই তাঁকে পির লোহানি বলে ডাকা হত। ইনি 'পিরবাবা' নামে পরিচিত। তিনি নাকি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁর অনেক কীর্তি আজও লোকমুখে ফেরে।

হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের নিকট তিনি সমান শ্রদ্ধেয়। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই পিরবাবার সমাধিতে সিরনি চড়ান আপন আপন মনস্কামনা পূরণের জন্য। পির লোহানির আস্তানার চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে উঁচু চত্বরের ওপর একগম্বুজবিশিষ্ট দুটি ঘর পাশাপাশি রয়েছে। পশ্চিমের ঘরে লাল কাপড়ে মোড়া পির লোহানির সমাধি আছে। সমাধির চারপাশ লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা এবং ওপরে চাঁদোয়া খাটানো আছে। আস্তানার কাছে বড় বড় পুরনো গাছ রয়েছে।

হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মনস্কামনা পূরণের জন্য পিরের উদ্দেশে পুজো দেন। পিরের উরস উত্‍সব সাড়ম্বরে পালিত হয়। এই উপলক্ষ্যে মেলা বসে। এই সমাধিস্থানটি মুসলমানরা তীর্থস্বরূপ মনে করেন। মালঞ্চ : খড়গপুর শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মালঞ্চের অবস্থান। মালঞ্চ শব্দের অর্থ ফুলের বাগান হলেও খড়গপুরের মালঞ্চে ফুল নয়, শোভা পাচ্ছে একগুচ্ছ মন্দির।

মন্দিরগুলির মধ্যে সেরা হল দক্ষিণকালীর মন্দির। গেটের সামনে গাছভর্তি হলুদ টিকামো পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। ছোট একটি প্রাঙ্গণ পেরিয়ে ইটের বাঁধানো চত্বর, তাতে হাঁড়িকাঠ পোঁতা, বোঝা যায় তাতে বলি হয়। হাঁড়িকাঠের একদম সোজাসুজি আটচালা মন্দির। উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। টকটকে লাল রঙের মন্দিরের গায়ে ফুটে রয়েছে নানাবিধ টেরাকোটার নিপুণ কাজ। তাতে রামায়ণের কাহিনি বিভিন্ন ভাস্কর্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। মন্দিরের ভেতরে করালবদনা কালী, দু'চোখ ভরে দেখার মতো। পাশে রয়েছে কৃষ্ণ, শীতলা, মনসার অধিষ্ঠান।

এছাড়াও রয়েছে রামকৃষ্ণ ও সারদার মূর্তি। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৩৪ শকাব্দ বা ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। এই মন্দিরের নির্মাতা জমিদার গোবিন্দরাম রায়। তিনশো বছর পূর্তি উত্‍সবে মন্দির ও তার প্রাঙ্গণ সংস্কার করা হয়েছে। নন্দেশ্বর শিব : কালীমন্দিরের উত্তরে রয়েছে নন্দেশ্বর শিবের দেউল। দেউলটি মাকড়া পাথরে নির্মিত। এর নির্মাণকাল ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে। দক্ষিণমুখী মন্দির। উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট।

বর্তমানে মন্দিরটিকে সুসজ্জিত করা হয়েছে। দক্ষিণাকালী থেকে সামান্য দূরত্বে রাস্তার পাশেই বীজেশ্বর মহাদেব মন্দির। এটিও নন্দেশ্বর শিবের মন্দিরের মতো মাকড়া পাথরের পীঢ়া জগমোহনযুক্ত শিখর দেউল। সামনেই নন্দীর অবস্থান ভাল লাগে। বালাজি মন্দির : খড়গপুর স্টেশনে আসার পথে পড়ে বালাজি মন্দির। দক্ষিণ ভারতীয়দের দ্বারা নির্মিত মন্দিরটি যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তেমন চমত্‍কার। মন্দিরটি আধুনিক হলেও পর্যটকদের ভাললাগার একটি জায়গা হবে বলেই মনে হয়। অনেকটি এলাকা জুড়ে দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির রীতির বালাজি মন্দিরের কমপ্লেক্স।

এই কমপ্লেক্সের মধ্যে আরও কতগুলি ছোট ছোট মন্দির আছে। যেমন পদ্মাবতী, নাঞ্চারী, পঞ্চমুখী হনুমান মন্দির, কাচের মন্দির, মেডিটেশন হল। মন্দিরগুলির মাঝে মাঝে ছোট ছোট কেয়ারি করা ফুলের বাগান, মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি খোদিত রয়েছে। মন্দিরটিতে পুরোপুরি দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির ছাপ রয়েছে। মন্দিরটি সত্যি অভিভূত করে দেয়। ঝাড়েশ্বর শিবের মন্দির : এই মন্দিরের কাছেই রয়েছে ঝাড়েশ্বর শিবের মন্দির। মন্দিরটি আকারে ছোট কিন্তু বয়সে প্রবীণ।

নিত্য পূজাপাঠ হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে শিবচতুর্দশী ও চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। ঝাড়েশ্বর শিব খুবই জাগ্রত বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। মন্দির প্রাঙ্গণের পাশেই রয়েছে মা আনন্দময়ী কালীর মন্দির। চুক্তিতে রিকশা বা অটো রিকশা নিলে মালঞ্চ ঘুরতে সুবিধা হয়। এছাড়া খড়গপুর স্টেশন থেকে নিমপুরায় যে মিনিবাস যায় তাতে ৫ কিলোমিটার দূরে মালঞ্চ আসা যায়।

অত্যুত্‍সাহীরা হেঁটেও জায়গাটির স্বাদ নিতে পারেন। হিজলি ইকো পার্ক খড়গপুর স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ৩৬৮৩ হেক্টর জঙ্গলের ওপর গড়ে উঠেছে হিজলি ইকো পার্ক এবং NTFP মিউজিয়াম। হিজলি, পোড়াপাড়া, খাজরা বিটের খড়গপুর ডিভিশনের এই জঙ্গলে শাল, মহুয়া, কেঁদ, আমলকী, বহেরা, হরীতকী, অর্জুন, পলাশ, পিয়াশাল প্রভৃতি গাছের অবস্থানের সঙ্গে বনসৃজনের ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিও রয়েছে। এখানে শিয়াল, হায়না, বনবিড়াল, বন্য শূকর, হরিণ ও খরগোশের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী।২০০৫ সালে এখানে বন্যপ্রাণী উদ্ধারকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। হিজলি ইকো পার্কের প্রবেশমূল্য ৫ টাকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ২ টাকা। এখানেই রয়েছে সুসজ্জিত বাগান ও মিউজিয়াম।