কোলকাতার জাগ্রত কালীবাড়ির অজান কাহিনী

আজবাংলা আমরা কালী মায়ের মন্দির বলতেই বুঝি সেই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মা নাহলে তারাপীঠের তারা মা। কিন্তু আমাদের কলকাতা শহরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক কালী মায়ের মন্দির। এই মন্দিরগুলির মধ্যে বেশির ভাগ মন্দিরগুলি অনেক পুরনো এবং সেই সঙ্গে ভীষণ জাগ্রত। আসুন জেনে নিন তেমনই কিছু মায়ের মন্দিরের সন্ধান ও সেইসঙ্গে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে ঘটনা।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি, বউবাজার- বউবাজার থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের দিকে যে রাস্তা গিয়েছে, সেই রাস্তার ডান দিকে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। একসময় এই অঞ্চলটি ছিল শ্মশান। হোগলাপাতার একটি ঘরে ছিল শিবের অবস্থান। সামনে ছিল গঙ্গা থেকে আসা একটা খাল। এই শিবমন্দিরে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আসতেন।একদিন এখানেই প্রতিষ্ঠিত হল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সিদ্ধেশ্বরী কালী।
পর্তুগিজ অ্যান্টনি মায়ের পুজোর দায়িত্ব দিলেন শ্রীমন্ত পণ্ডিতকে।এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অ্যান্টনি কবিয়ালের নাম ও নানা কাহিনি। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়েও গবেষকদের মধ্যে রয়েছে মতান্তর। কারও কারও মতে এক নমঃশূদ্র ব্যক্তি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।অন্য একটি মত অনুসারে প্রথমে এখানে ছিল একটি শিবমন্দির। সেই সময় শ্রীমন্ত পণ্ডিত নাকি বসন্ত রোগের চিকিৎসা করতেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান-ফিরিঙ্গি অধ্যুষিত বউবাজার অঞ্চলে তিনি বহু মানুষকে চিকিৎসা করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
জনশ্রুতি, এই মন্দিরের পাশের গলিতে থাকতেন অ্যান্টনি সাহেবের মামা অ্যারাটুন সাহেব। সেখানে যাতায়াত থাকায় মাঝে মাঝে অ্যান্টনি সাহেব নাকি মন্দিরের চালায় বসে গান গাইতেন। প্রতিদিন মন্দির রাত ন’টায় বন্ধ হলেও দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন যতক্ষণ অমাবস্যা থাকবে মন্দির খোলা থাকবে।প্রতি বছর কালীপুজোর আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়। কালীপুজোর দিন মায়ের ভোগে থাকে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, দু’রকমের তরকারি, পোলাও, চাটনি, পায়েস।
এছাড়া থাকে দই, মিষ্টি।শোনা যায়, মন্দিরের পুরনো মূর্তিটি ছিল মাটির। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় পুরনো মূর্তিটি ধ্বংস হয়ে যায়।পরে ১৯৮৭ সালে কংক্রিটের মূর্তিটি তৈরি করা হয়। কালীপুজোয় আজও বহু ভক্ত সমাগম হয় এখানে। মায়ের মন্দিরের পিছনে রয়েছে একটা কাঠচাঁপা গাছ, যার গোড়াটি মহাদেবের বাহন ষাঁড়ের মতো। অনেকেই মানতের জন্য এখানে কাপড় বেঁধে যান।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমা, ঠনঠনিয়া- আগে অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলে ভরা। বহু যুগ আগে সেখানেই উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী একটি উঁচু মাটির ঢিপির উপর চালাঘরে পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে কালীসাধনা করতেন। কাছেই বাহির সিমলা অঞ্চলে থাকতেন রামশঙ্কর ঘোষ, যিনি পরবর্তী কালে শঙ্কর ঘোষ নামে পরিচিত হন।তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়ান। শোনা যায়, তাঁর সঙ্গে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারীর যোগাযোগ ছিল।পরে উদয়নারায়ণ কাশী যাওয়ার আগে শঙ্কর ঘোষকে দেবীর দায়িত্ব দিয়ে যান।
শঙ্কর ঘোষ সেখানেই পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর কালীমূর্তি ও ঘট প্রতিষ্ঠা করে একটি মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন যা আজকের ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির।মন্দিরের গায়ের ফলকে দেখা যায়, বাংলার ১১১০ সনে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। দীপান্বিতা কালীপুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী থেকেই। তখন দেবীর বিগ্রহের অঙ্গরাগ করা হয়। ত্রয়োদশীর দিন তাঁকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সে দিন স্নান করিয়ে রাতে পরানো হয় লালপেড়ে সাদাশাড়ি। কালীপুজোর দিন পরানো হয় বেনারসী শাড়ি। মন্দিরে অন্নভোগ না হলেও কালীপুজোর বিশেষ ভোগে দেওয়া হয় লুচি, আলু-পটল ভাজা, আলুর দম, ধোঁকার ডালনা ও নানা ধরনের মিষ্টি।আজও ভক্তদের মানতের বলিদান হয় এখানে। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় বিশেষ পুজো ছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালী ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপুজো হয়।
করুণাময়ী কালীমা, টালিগঞ্জ- বড়িশা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের নন্দদুলাল রায়চৌধুরী তাঁর অকালপ্রয়াতা মেয়ে করুণা-র স্মৃতিতে ১৭৬০ সালে পশ্চিম পুঁটিয়ারি অঞ্চলে দ্বাদশ শিবমন্দির-সহ একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মেয়ের নামেই বিগ্রহের নামকরণ করা হয় করুণাময়ী। কষ্টিপাথর কেটে বিগ্রহটি তৈরি করা হয়েছিল যা পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর প্রতিষ্ঠিত।কালীপুজোর সময় দেবীকে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। পুজো হয় ষোড়শোপচারে। হয় কুমারী পুজো। কালীপুজোর বিশেষ ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, মোচার ঘন্ট, এঁচোড়ের ডালনা, লুচি ছোলার ডাল, পোলাও, নানা রকমের তরকারি, দশ রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস।
কালীঘাট- কালীঘাটের বর্তমান মন্দির দুশো বছরের বেশি পুরনো নয়। হাটখোলার দত্ত পরিবারের কালীপ্রসাদ দত্ত এবং বড়িশার সাবর্ণ রায়চোধুরী পরিবারের সন্তোষ রায়চৌধুরী এই মন্দির নির্মাণ করান। কালীঘাট তীর্থের উল্লেখ রয়েছে ১৫ শতকের মনসা ভাসানের গানে। ১৭ শতকের ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’-তেও এর উল্লেখ রয়েছে। তবে এই তীর্থের বয়স আরও বেশি বলেই মনে করেন গবেষকরা।
আদিতে এটি একটি পর্ণকুটির ছিল। ১৬ শতকে রাজা মানসিংহ প্রথম একটি পাকা মন্দির নির্মাণ করান। কালীঘাটকে সতীর একান্নপীঠের অন্যতম ধরা হয়। সে দিক থেকে দেখলে এর প্রাচীনত্ব আরও বেশি। কালীঘাটের মাতৃমূর্তির সঙ্গে অন্য কোনও কালীমূর্তির কোনও মিল নেই।এই মূর্তি অনন্য। একান্ন পীঠ বলে পরিচিত তীর্থগুলিকে বজ্রযানী বৌদ্ধ তীর্থ হিসেবে অনেকে মনে করেন। এবং প্রতিটি তীর্থেই কোনও না কোনও প্রস্তরকে দেবীরূপে পূজা করা হয়। সেদিক থেকে দেখলে কালীঘাটের কালীমাতাও শিলাস্বরূপা।
মাতৃমূর্তির বর্তমান রূপটি দান করেন ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম গিরি নামের দুই সন্ন্যাসী। কলকাতা অঞ্চলে প্রাচীন নাথ ধর্মের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ‘চৌরঙ্গী’ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নাথ-কিংবদন্তি। কালীঘাটের সঙ্গে নাথপন্থীদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল বলে অনেক গবেষক অনুমান করেন।কালীঘাটের কালীর ভৈরব হলেন নকুলেশ্বর মহাদেব। তাঁর মন্দির কালীমন্দিরের কাছেই। আগে এই স্থান গভীর জঙ্গলে আকীর্ণ ছিল। কালীঘাট মন্দিরের সংলগ্ন ১০ কাঠার একটি পুকুর রয়েছে। কথিত আছে, এই পুকুর থেকেই সতীঅঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
এই পুকুরের নাম ‘কুণ্ড পুকুর’ বা ‘কুন্ডু পুকুর’। এর জলকে গঙ্গাজলের তুল্য পবিত্র ধরা হয়।ইংরেজ আমলে কালীঘাটের অন্য প্রতিপত্তি বাড়ে। এক একটা বড় কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা নিয়মিত এই মন্দিরে আসতেন এবং একপ্রকার বিশ্বাস থেকে পুজোও দিতেন। হিন্দু মন্দিরে ইউরোপীয়দের আগমন তেমন সুলভ ছিল না সেযুগে। কিন্তু কালীঘাটে সেটা নিয়মিত হয়ে ওঠে।এখানেই কিন্তু শেষ নয়। কোলকাতার আরও বাকি কালী মন্দিরের ইতিহাস জানুন দ্বিতীয় পর্বে।