তুলসী গব্বার্ডঃ মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম হিন্দু প্রতিনিধি তুলসী গ্যাবার্ড

তুলসী গব্বার্ডঃ  মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম হিন্দু প্রতিনিধি তুলসী গ্যাবার্ড

তিনি ভারতকে ভালবাসেন। আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে, হিন্দু ভারতকে ভালবাসেন। হিন্দুধর্ম তাঁহার মতে শ্রেষ্ঠ ধর্ম, গীতা শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে গীতা উপহার দিয়াছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসের একমাত্র হিন্দু প্রতিনিধি তুলসী গ্যাবার্ডের এই কৃতি খবরের শিরোনাম হইয়াছিল। রাজনীতির অঙ্গনে আনুষ্ঠানিক প্রবেশকালে যে গীতা হস্তে লইয়া তিনি শপথবাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, ইরাকে ‘ওয়ার ডিউটি’র সময়েও যাহা ছিল তাঁহার নিত্যসঙ্গী, ব্যক্তিগত স্মৃতিবিজড়িত সেই গ্রন্থটিই নরেন্দ্র মোদীকে দেওয়ায় তুলসীর নামে ধন্য-ধন্য রব তুলিয়াছিল আমেরিকার হিন্দু ভারতীয়রা। হিন্দু জীবনবোধের প্রতি তাঁহার গোঁড়া ভক্তি তাঁহাকে অনাবাসী হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের পরম বন্ধু করিয়া তুলিয়াছে।

তুলসীর নির্বাচনী প্রচারে হিন্দুত্ববাদীদের বড় অবদান দেখা গিয়াছে। আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল নাগরিক সভা-অনুষ্ঠানে বারংবার দেখা গিয়াছে তুলসীকেও। কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রথম হিন্দু প্রতিনিধি হলেন ৩৭ বছর বয়সী তুলসী গ্যাবার্ড। এ ছাড়া তুলসীই প্রথম হিন্দু নারী, যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নাম লেখাতে পেরেছেন। তুলসী গ্যাবার্ডের মা ক্যারোল এবং বাবা মাইক গ্যাবার্ড ছিলেন আমেরিকান সামোয়া। মার্কিন সামোয়া দ্বীপে ১৯৮১ সালের ১২ই এপ্রিল জন্ম হয় তুলসীর । তার যখন দুই বছর বয়স তখন তারা সপরিবারে হাওয়াই দ্বীপে চলে যান। তিনি একটি বহুসাংস্কৃতিক পরিবারে বড় হন। তার পিতামাতা পূর্বে খ্রিস্টান ছিলেন। তার বাবা সামোয়ান ও ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত এবং ক্যাথলিক গির্জার সক্রিয় সদস্য। তার মা জার্মান বংশোদ্ভূত। যিনি জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাজ্য়ের ডিসকুরে। গ্যাবার্ডের মা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন এবং পরে তার পিতা ও তার মাকে অনুসরণ করে। তার পিতার মন্ত্র, ধ্যান ও স্তবে খুব আগ্রহ ছিল। তিনি তার পিতামাতার চতুর্থ মেয়ে। তার চার ভাই ও এক বোন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তানের নাম হল: ভক্তি, জয়, আরিয়ান, তুলসী ও বৃন্দাবন।

গ্যাবার্ডের মা, প্রতিদিন ভগবত গীতা পড়তেন এবং শিশুদের এর গুরুত্ব বোঝান। তিনি পাঁচ সন্তানের মধ্যে ভগবত গীতার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিশোরী অবস্থায় তিনিও তার মায়ের মত হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।[৩] তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত অনুসরণ করেন ও তিনি নিরামিষভোজী।[৪] বৈষ্ণব হিন্দু হিসেবে তিনি বিষ্ণুর অবতার ও রামায়ণ সম্পর্কে জানেন। তিনি মহাভারতকে গ্রহণ করেছিলেন। এই মহান গ্রন্থগুলির গ্যাবার্ডের মনের উপর দুর্দান্ত প্রভাব রয়েছে।তিনি ভাগবত গীতাকে একটি আধ্যাত্মিক নির্দেশিকা হিসাবে প্রশংসা করেন।[৫] গ্যাবার্ড নিজেকে একজন কর্মী যোগী হিসাবে বর্ণনা করেছেন।[৬] তিনি ২০১৩ সালে প্রথম হিন্দু হিসেবে হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ ভগবদ্গীতায় হাত রেখে মার্কিন সেনেটে শপথ গ্রহণ করেন।২০১৫ সালে হাওয়াইয়ে তিনি চলচ্চিত্রগ্রাহক এব্রাহাম উইলিয়ামসকে বৈদিক রীতিতে বিয়ে করেন।

তুলসির দুই বছর বয়সে তাঁরা পাকাপাকিভাবে হাওয়াইয়ে চলে যান। খ্রিষ্টান হলেও বাড়িতে কীর্তন চর্চা হতো। তাঁর মা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের কিছু আচার, রীতি-নীতিও পালন করতেন। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে কিশোরী বয়সে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন তুলসী। তুলসী মার্কিন কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে চার বারের ডেমোক্র্যাট সদস্য তিনি। নিজের কেন্দ্র হাওয়াইকে হাতের তালুর মতো চেনেন।তুলসী গ্যাবার্ড আলোচ্য হইয়া উঠিয়াছেন তাঁহার দলীয় পরিচয়ের কারণেও। তিনি ডেমোক্র্যাট দলের প্রতিনিধি— যে দল সচরাচর উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক পথের পথিক। যে বহুত্ববাদ ও মানববৈচিত্রের উদ্‌যাপন আমেরিকার ভিত্তি, ডেমোক্র্যাটরা তাহার প্রচার-প্রসারে বদ্ধপরিকর।

তুলসীর রক্তেও বহুত্ববাদ: পিতা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ আমেরিকান সামোয়ার শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী, আবার মাতা শ্বেতাঙ্গ হইয়াও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে বিশ্বাসী। সুতরাং পারিবারিক এবং দলীয় মতাদর্শের দিক দিয়া দেখিলে সর্বমতসহিষ্ণুতা তাঁহার কাছে প্রত্যাশিত। তাঁহার প্রতীতি হিন্দুধর্মে, ভক্ত-বন্ধুগণের নিকট তিনি এই ধর্মে ফিরিবারই আহ্বান জানান। ইহা শিকড়ে ফিরিবার আহ্বান বটে । তুলসীকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ নিয়ে ডোমোক্র্যাটদেরই তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের কড়া সমালোচক আমেরিকা।

যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং রাসায়নিক হামলা চালানো সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ হেন আসাদের সঙ্গে ২০১৭ সালে তুলসীর সাক্ষাত্ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। সিরীয় মানুষের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেন বলে সেই সময় দাবি করেন তিনি। এমনকি রাসায়নিক হামলায় আদৌ আসাদের হাত রয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দেন। তাঁর এমন অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা। রিপালিকানদের তরফে তাঁকে আসাদের মুখপাত্র বলেও উল্লেখ করা হয়। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিন্টনের বদলে বার্নি স্যান্ডার্সকে সমর্থন করায় ডেমোক্র্যাটদের একাংশও তাঁর উপর চটে যান।

অল্প বয়সেই তিনি তার বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করতেন। মার্শাল আর্ট তার প্রিয় ছিল।  তিনি শরীরচর্চায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আনন্দের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হওয়ার সময় দায়িত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হাওয়াইয়ে তিনি অধ্যয়ন করেন।২ বছর তিনি ফিলিপাইনের হাই স্কুলে পড়েন।হাওয়াইয়ের প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্নাতক করেন। ২০০২ সালে একুশ বছর বয়সে হাওয়াই আইন পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আমেরিকান সেনাতে যোগদান করেন। ২০০৪ সালে তিনি ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন । এক বছরের জন্য সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করেছিলেন এবং সৈন্যদের সাথে ফিরে এসেছিলেন।সেখান থেকে ফিরে আসার পর তাকে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ।

যা তিনি সেনা কর্মকর্তাদের বাইরে প্রথম অর্জন করেন। ২০০৮ সালে তিনি কুয়েতের যুদ্ধে যান। কুয়েতের সৈনিকরা তার বীরত্ব , সাহস এবং সময় সচেতনতা দেখে প্রভাবিত হয়েছিল ।তারা তাকে পুরস্কৃত করেছিল। কুয়েতের ইতিহাসে তার পাওয়া এ পুরস্কার প্রথম বার কোন মহিলার সাহসিকতার জন্য প্রাপ্ত পুরস্কার ছিল। তুলসী গ্যাবার্ড ২০১০ সালে হনলুলু নগর পরিষদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার নিম্নকক্ষ কংগ্রেস বা হাউস অফ রেপ্রেজেন্টেটিভসের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব কৃতিত্ব, যার ফলে তুলসী গ্যাবার্ড ৩১ বছর বয়সে প্রথম হিন্দু নারী হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসে যোগ দেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত দুজন নারীর একজন যার সামরিক পটভূমি আছে। প্রথম হিন্দু সাংসদ হিসেবে তিনি গীতায় হাত রেখে শপথ নেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ববি জিন্দাল এবং নিকি হেলিও সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন।

কিন্তু সম্ভবত অনেকে জানেন না যে হিন্দু ববি ও শিখ নিকি উভয়ই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ববি তার ভারতীয় উৎস ধর্ম ত্যাগ করেন। কিন্তু  তুলসী গ্যাবার্ডের এতে সম্পূর্ণভাবে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তুলসী গ্যাবার্ড বলেন "যখন আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম, কেউ তখন জিজ্ঞেস করলো না কোন ধর্মের ছিলাম এবং এখন কেন এটা এখন করা হবে?" এ কারণে আমেরিকায় আজকের হিন্দুরা তার কাছাকাছি। তিনি সোজা এবং সাহসী। তিনি নরেন্দ্র মোদীর ভিসা বাতিলের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ভুল করছে। তিনি ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরোধিতা করেন।   তিনি অন্য দেশগুলির সাথে যুদ্ধের জোরালোভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। সেপ্টেম্বরে যখন নরেন্দ্র মোদী মেডিসন স্কোয়ারে আসেন তখন তুলসীর সাথে দেখা করেন। তিনি ভারতে আসার জন্য তাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। নভেম্বরে নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি আবার নির্বাচিত হন। 

 তার মতে "আমার জীবনের অনুপ্রেরণা এবং সাহসের উৎস ভগবত গীতা। ভগবত গীতার শিক্ষায় তার হৃদয় থেকে উদ্ভূত হয় সাহস, শান্তি, সান্ত্বনা, ধৈর্য ও সামাজিক সেবার উৎস পায় ।" ভক্তিযোগ এবং কর্মযোগ অধ্যায় তার প্রিয় হলেও, সাংখ্য়‌যোগের ২৩ তম শ্লোকটি তার খুব প্রিয়।  তা হল: নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ । ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥ অর্থ: আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না আগুনে পোড়ান যায় না জলে ভেজান যায় না অথবা হাওয়ায় শুকানোও যায় না। ব্যক্তিত্বের বিবর্তন মূলত কিভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার জীবন তা গ্রহণ করেছে।এর ফলাফল তার সাফল্য ।