উড়া দেবী এর জীবনী

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে অন্যতম দলিত নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী উড়া দেবী (Uda Devi) ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহে নারীর প্রসঙ্গ উঠলেই রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের কথা জনমানসে আলোচিত হলেও সামান্য এক দলিত হওয়ার কারণে উড়া দেবী র নাম প্রকাশ্যে আসে না সেভাবে। লক্ষ্ণৌতে সিকান্দার বাগে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে বত্রিশ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন উড়া দেবী। অসম সাহসী উড়া দেবী ছিলেন ‘দলিত বীরাঙ্গনা’। শুধুমাত্র দলিত হওয়ার কারণে ঝল্কারী বাঈ যেভাবে সিপাহি বিদ্রোহের উচ্চবর্ণের ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন, দলিত নারী উড়া দেবীর নামও তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার একটি ছোট্ট গ্রামে উড়া দেবী র জন্ম হয়।
খুব ছোট বয়সেই চারপাশে মানুষদের মধ্যে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করে উড়া দেবী নিকটবর্তী বেগম হজরত মহলে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নাম নথিভুক্ত করান। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বেগম তাঁকে একটি নারীবাহিনী গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। ব্রিটিশদের পরাধীনতা থেকে মুক্তির আশায় যুদ্ধের জন্য তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন।
বেগমের সহায়তাতেই অবশেষে ‘বীরাঙ্গিনী’ নামে একটি নারীবাহিনী গঠিত হয় উড়া দেবীর নেতৃত্বে আর এই বাহিনী নিয়েই ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন উড়া দেবী । ব্রিটিশরা অযোধ্যা আক্রমণ করলে উড়া দেবী এবং তাঁর স্বামী উভয়েই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ সালের শরৎকাল নাগাদ সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে তৈরি হয়েছিল প্রবল বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য।
ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিরোধিতা আর রোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। দিল্লি, ঝাঁসি আর কানপুরের ভারতীয়রা তখন উন্মত্ত হাতির মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যেন সুযোগ এলেই প্রবল বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে তারা। লক্ষ্ণৌতে গোমতী নদীর ধারে বাড়িগুলিতে ব্রিটিশ সেনার ছোট একটি দল তখন প্রাণ হাতে নিয়ে ভারতীয়দের পরাস্ত করার জন্য অপেক্ষমান।
১৮৫৭ সালের সমগ্র গ্রীষ্মকাল জুড়ে তারা বিক্ষুব্ধ ভারতীয়ের মাঝে কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়ে থেকেছিল। যে কোনো মুহূর্তে উন্মত্ত ভারতীয়দের হাতে তাদের প্রাণনাশ হতে পারতো। নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ কলিন ক্যাম্পবেল শত্রুর সীমানা অতিক্রম করে অনুপ্রবেশ করেন এবং সেখানকার বন্দি সৈন্যদের উদ্ধার করেন। গোমতী নদীর দক্ষিণ পাড় ধরে ক্যাম্পবেলের নির্দেশে তিরানব্বইতম ব্রিটিশ হাইল্যাণ্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা সিকান্দার বাগ প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসে ক্রমশ।
ব্রিটিশদের অগ্রসর হতে দেখে ভারতীয় বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধ শুরু করে দেয়। সেই যুদ্ধে প্রায় দুই হাজার লোক মারা যায় যার মধ্যে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সৈন্য উভয়ই ছিল। লক্ষ্ণৌয়ের এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই যুদ্ধেই উড়া দেবীর স্বামী মক্কা পাসি মারা যান ব্রিটিশদের গুলিতে। স্বামীর মৃত্যুতে ক্রোধান্বিত উড়া দেবী নিজেই এবার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
সিকান্দার বাগের দিকে অগ্রসরমান ব্রিটিশ সৈন্যদের লক্ষ্য করে উড়া দেবী পুরুষের ছদ্মবেশে একটি পিপুল গাছে উঠে পড়েন এবং গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্য করে পরপর বত্রিশ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে গুলি করে হত্যা করেন। যুদ্ধ চলাকালীনই এক অফিসার লক্ষ্য করেন যে বেশিরভাগ ব্রিটিশ সৈন্যই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন এবং সেই গুলির গতিপথ অনেকটা উপর থেকে নীচে নেমে আসছে যেন।
আর এই সন্দেহ আসা মাত্রই সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে দেখতে দেখতেই গাছের মাথায় একটি স্নাইপার বন্দুক লক্ষ্য করেন ব্রিটিশ অফিসার। সেই বন্দুক লক্ষ্য করে গুলি চালানো মাত্র এক বিপ্লবীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ গাছ থেকে পড়ে যায়। পরে অনুসন্ধানের সময় দেখা যায় সেই বিপ্লবীই আসলে ছদ্মবেশী উড়া দেবী। শোনা যায় ব্রিটিশ অফিসার ক্যাম্পবেলও তাঁর সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে মাথা নত করেছিলেন তাঁর মৃতদেহের সামনে।
উইলিয়াম ফোর্বস মিচেলের লেখা ‘রেমিনিসেন্সেস অফ দ্য গ্রেট মিউটিনি’ বই থেকে জানা যায় যে উড়া দেবীর কাছে এক জোড়া পুরনো মডেলের পিস্তল ছিল যার মধ্যে একটি তাঁর বেল্টে গুলিপূর্ণ অবস্থায় রাখা ছিল আর তাঁর হাতে থাকা পিস্তলে অর্ধেক গুলি ভরা ছিল যা গাছে ওঠার আগে পর্যন্ত ভর্তি ছিল বলেই অনুমান করা হয় তা না হলে এত সৈন্যকে হত্যা করতে পারতেন না তিনি।
সংখ্যালঘু দলিত নারী জাতির কাছে উড়া দেবী এক অনুপ্রেরণার নাম। প্রতি বছর ১৬ নভেম্বর তারিখে পাসি জাতির সকল মানুষ উড়া দেবীর মৃত্যুস্থলে এসে সমবেত হন এবং তাঁর সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানান। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ থেকেও পাসি সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিনে সমবেত হন সেখানে। এক শতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে উড়া দেবীর নাম সতত সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
তাঁর অনুপ্রেরণাতেই উত্তরপ্রদেশের প্রাদেশিক সশস্ত্র পুলিশবাহিনীতে রাজ্য সরকারের তরফে ওবিসি এবং দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলাদের নিয়োগ করা হয়। মূলত এই নারীবাহিনী যে কোনো নারী সমাবেশ বা বিক্ষোভ দমন করতে সহায়তা করে থাকে। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত একটি ছড়া হল – ‘কোই উনকো হাব্সি ক্যাহ্তা, কোই ক্যাহ্তা নীচ অচ্ছুৎ অবলা কোই উন্হে বাতলায়ে, কোই ক্হে উন্হে মজবুত।’ অর্থাৎ উড়া দেবীকে কেউ কেউ কালো আফ্রিকান নারী বলতেন, কেউ তাঁকে ডাকতেন নীচ-অচ্ছুৎ বা অস্পৃশ্য বলে।
আবার কেউ তাঁকে অবলা নারী ভেবেছিলেন, কেউ ভেবেছিলেন তাঁর মতো কঠোর চারিত্রিক দৃঢ়তা আর কারো নেই। যদিও এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে, কিন্তু উত্তরপ্রদেশের জনশ্রুতিতে এই ছড়াটি বহুল প্রচলিত। অসম সাহসী উড়া দেবী ছিলেন ‘দলিত বীরাঙ্গনা’। শুধুমাত্র দলিত হওয়ার কারণে ঝল্কারী বাঈ যেভাবে সিপাহি বিদ্রোহের উচ্চবর্ণের ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন, দলিত নারী উড়া দেবীর নামও তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। ১৮৫৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিকান্দার বাগের যুদ্ধক্ষেত্রেই ব্রিটিশ সৈন্যের গুলিতে উড়া দেবীর মৃত্যু হয়।