উলুবেড়িয়া

উলুবেড়িয়া

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হাওড়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল উলুবেড়িয়া (Uluberia)। উলুবেড়িয়া মহকুমার সদর দপ্তর এই জনপদ একটি পুর এলাকা এবং কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটির আওতাধীন। ভৌগোলিক দিক থেকে এই জনপদ ২২.৪৭০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.১১০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। সমুদ্রতল থেকে ৩.৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই জনপদটি।

হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত উলুবেড়িয়ার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড। তাছাড়া ৬ নং জাতীয় সড়ক এবং বম্বে রোডের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছে উলুবেড়িয়া । এর চারপাশে রয়েছে ফুলেশ্বর, চেঙ্গাইল, বাউরিয়া, বীরশিবপুর এবং কুলগাছিয়া। উলুবেড়িয়ার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। তবে বেশিরভাগই মনে করেন যে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগে ‘উলু’ ঘাসে ভরা ছিল।

 ঐতিহাসিক দিক থেকে জানা যায় ১৬৮৬ সালে জব চার্ণক প্রথম হুগলি নদীর তীরে এই উলুবেড়িয়াতে জলপথে বাণিজ্য করার জন্য স্থায়ী বসতি নির্মাণ করেন। নবাবের বক্সী আবদুস সামাদের সঙ্গে জব চার্ণকের একটি বারো দফার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার মধ্যে চার্নকের অন্যতম দাবি ছিল উলুবেড়িয়াতে কুঠি নির্মাণ করা। ১৬৮৮ সালের ২৭ আগস্ট ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নবাবের এই পরোয়ানায় সম্মত হয় এবং জব চার্নককে কুঠি নির্মাণে অনুমতি দেয়।

ফোর্ট সেন্ট জর্জ নামে একটি কুঠি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন জব চার্নক। ধীরে ধীরে সমগ্র জনপদটিকে আস্ত ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। উলুবেড়িয়ায় কুঠি তৈরি শুরু হলে জনপদের স্থানীয় অধিবাসীরা নবাবের কাছে আপত্তি জানিয়ে বলে যে গঙ্গার ধারেই ইংরেজদের কুঠি নির্মিত হলে হিন্দু মেয়েদের সম্ভ্রম ও আব্রু রক্ষা করা দায় হয়ে উঠবে। এই বিরোধিতা শুরু হলে নবাব নির্দেশনামা জারি করে কুঠি তৈরির কাজ বন্ধ করে দেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক দিয়ে জব চার্ণক বাণিজ্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এতেও নবাব বাধা দেন।

ফলে মুঘলদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরোধ দেখা দেয় এবং উলুবেড়িয়া থেকে বাধ্য হয়ে নদীপথে সুতানুটিতে চলে আসেন জব চার্নক। একে জায়গাটি পলি মাটি পরিপূর্ণ ছিল, তাই দূর্গ নির্মাণের জন্য অনুপযুক্ত ছিল। তাছাড়া মুঘলদের অতিরিক্ত করের চাহিদা এবং আক্রমণের কারণে জব চার্ণক দূর্গ নির্মাণে সক্ষম হননি এখানে। অনেকে মনে করেন যে, এখানে অত্যধিক মশার উপদ্রবের কারণে এবং তা থেকে রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয়েই জব চার্ণক সুতানুটি চলে গিয়েছিলেন। উলুবেড়িয়ার ইতিহাসের সঙ্গে তাই জব চার্নকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।

১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ তথা ১৯১৮ সালে উলুবেড়িয়ায় স্থাপিত হয় এখানকার ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন আনন্দময়ী কালীমন্দির। তৎকালীন উলুবেড়িয়ার মহকুমা শাসক যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুন্সেফ শশীজীবন সেন একত্রে এই মন্দির নির্মাণ করেন হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে। শরৎচন্দ্র ধারা, নারায়ণচন্দ্র মান্না, অবিনাশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী ব্রতবাণী দেবী এই মন্দির নির্মাণের কাজে সহায়তা করেছিলেন। আন্দুল রাজ পরিবারের জমিদার শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র মন্দির তৈরির জন্য এক বিঘা জমি দান করেছিলেন বলে জানা যায়।

মেদিনীপুরের রামবাগ গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্রমোহন মাইতি এই মন্দিরের কারুকার্য তৈরি করেছিলেন এবং কাটোয়ার ভাস্কর গোকুল তৈরি করেছিলেন এই মন্দিরের কালী মূর্তিটি। এই মন্দির নির্মাণের কিছুকাল পরে ১৯২০ সালে অবিনাশচন্দ্র একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন, ১৯২১ সালে দ্বারিক কয়াল তৈরি করেন একটি রাধাগোবিন্দের মন্দির এবং ১৯২৩ সালে কালাচন্দ্র চন্দ্র এখানে একটি সাবিত্রী মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরটিও উলুবেড়িয়ার ইতিহাসের অপরিহার্য অঙ্গ। এই উলুবেড়িয়া কালীবাড়ির কাছেই ভাগীরথী নদীর ধারে একটি জমিকে জব চার্নকের বাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয়রা।

এই জমিকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যদিও এই স্থানে সত্যই জব চার্ণক থাকতেন কিনা সে বিষয়ে পাথুরে প্রমাণ মেলেনি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১৬৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জব চার্ণক প্রথম সুতানুটিতে নেমেছিলেন এবং এর তিন মাস পরে তিনি চলে যান উলুবেড়িয়ায়। উলুবেড়িয়ায় মাস তিনেক সময় কাটান জব চার্ণক এবং ১৬৮৭ সালে আবার সুতানুটিতে ফিরে আসেন।

১৯৫১ সালে রাসবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় উলুবেড়িয়ায় রাস উৎসবের সুচনা করেন, সেই থেকে প্রতি বছর মহা ধুমধাম করে এখানে রাসমেলা এবং রাস উৎসব পালিত হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে আরও জানা যায় যে ১৯৪০ সালের ৪ মে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে উলুবেড়িয়ায় এক বিরাট সভা করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। গরুহাটার মাঠের সেই সভায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সুভাষচন্দ্রের হাতে প্রভূত অর্থ তুলে দিয়েছিলেন। প্রাচীনকালে উলুবেড়িয়ার শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য খুব একটা সুগঠিত ছিল না।

এখানে মূলত কৃষিজীবি এবং মৎস্যজীবিদের বসবাস ছিল। ১৮৭৯ সালে এই জনপদে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় উলুবেড়িয়া হাই স্কুল। তারপর থেকেই এখানকার শিক্ষাগত পরিবেশ বদলাতে শুরু করে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হরিপদ ঘোষাল ১৯৪৮ সালে স্থাপন করেন উলুবেড়িয়া কলেজ। এই কলেজেই শিক্ষক শিক্ষণের বিভাগও চালু হয় যা সমগ্র হাওড়া জেলার মধ্যে অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। সমগ্র উলুবেড়িয়াতে ১০০টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫টির মতো উচ্চ বিদ্যালয় এবং ৬-৭টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

পেশাদার এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এখানে। উৎসব বলতে উলুবেড়িয়ার প্রাণ হিসেবে রাস উৎসবের নামই সর্বাগ্রে স্মর্তব্য। প্রতি বছর মহা সমারোহে রাস উৎসব পালিত হয় এখানে, উৎসবকে কেন্দ্র করেই বসে রাসের মেলা। এছাড়াও রথযাত্রা, দোলযাত্রা, শিবরাত্রি, দুর্গাপূজা, কালীপূজাও সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় এখানে। আনন্দময়ী কালীবাড়িতে শিবরাত্রি এবং কালীপূজাকে কেন্দ্র করে মানুষের ঢল নামে। পাশেই রয়েছে বিশাল দুর্গামণ্ডপ – এখানেই দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। আর এছাড়া পৃথক পৃথক ক্লাবের উদ্যোগে সার্বজনীন পুজো তো রয়েছেই।

কালীবাড়ির দুর্গাপূজায় বলি দেওয়া হয় না, এখানকার প্রসাদে আর কিছু না থাক, খিচুড়ি ভোগ অবশ্যই থাকে। বলা যায় এটাই এখানকার প্রাচীন রীতি।   একসময় উলুবেড়িয়া শাটল কর্ক উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিশ্বায়নের দৌড়ে সেই ঐতিহ্য এখন লুপ্ত। তবে মাটির পাত্র নির্মাণ, কাপড় ও মাটির পাত্রের উপর অঙ্কনশিল্প এখনও উলুবেড়িয়াকে মহিমান্বিত করে রেখেছে। তাছাড়া নানাবিধ জরির কাজের জন্যেও এই জনপদ বিখ্যাত ছিল। উলুবেড়িয়ার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় আনন্দময়ী কালীবাড়ির কথা।

এটি উলুবেড়িয়া কালীবাড়ি নামেই সমধিক পরিচিত। এছাড়াও আশেপাশে রয়েছে বিবেকানন্দ উদ্যান, বেলাড়ী রামকৃষ্ণ মঠ এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় গড়চুমুক পর্যটন কেন্দ্র। ঠিক উলুবেড়িয়া য় না হলেও আশেপাশের এই স্থানগুলি অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। উলুবেড়িয়া স্টেশন থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে এই গড়চুমুক পর্যটন কেন্দ্রে দামোদর নদীর জলধারা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫৮টি স্লুইস গেট বসানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বনদপ্তর এবং হাওড়া জেলা পরিষদের উদ্যোগে এই নদীর ধারে প্রায় ১৩৭ একর এলাকা জুড়ে একটি বনভূমি গড়ে তোলা হয়েছে যা মূলত ‘উলুঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মৃগদাব’ নামে পরিচিত।

হরিণ, খরগোশ, ময়ূর, সজারু, কুমির ছাড়াও শীতকালে এলে প্রচুর পাখি দেখা যায় এখানে। নিবিড় অরণ্যের শান্তি, লালমাটির রাস্তা আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কল্লোলে মন প্রশান্ত হয়ে যাবে নিশ্চিত। এছাড়া রয়েছে ফুলেশ্বরের পিকনিক স্পট, গঙ্গার পাড়ে নির্জন মনোরম জায়গায় অনেকেই পিকনিক করতে আসেন। সবশেষে অনন্য সুন্দর বেলাড়ী রামকৃষ্ণ মঠ দেখার সুযোগ ছাড়া ঠিক নয়। প্রফুল্ল মহারাজ নামে এক উদ্যোগী সাধুর প্রচেষ্টায় গ্রামে শিক্ষার আলো আনতে এই মঠ স্থাপিত হয়েছিল, মঠের সংলগ্নেই রয়েছে অবৈতনিক বিদ্যালয়।

১৯৩০-এর দশকে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে তাঁর এই প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছিল দাতব্য চিকিৎসালয়, চরকা ও তাঁতের সাহায্যে দেশীয় কাপড় নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি। ঐতিহাসিক দিক থেকে জব চার্ণকের স্মৃতি বুকে নিয়ে গঙ্গার তীরে স্নিগ্ধ সমীরে জীবন জুড়ানো হাওয়ায় উলুবেড়িয়া এক শান্ত জনপদ হয়ে এগিয়ে চলেছে প্রগতির পথে।