রাষ্ট্রসংঘ দিবস

রাষ্ট্রসংঘ দিবস United Nations Day প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যে একটি হল রাষ্ট্রসংঘ দিবস (United Nations Day)।
প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর সারা বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রসংঘ দিবস পালিত হয়। এই দিনেই ১৯৪৫ সালে গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ (United Nations) আর এই প্রতিষ্ঠা দিবসকে স্মরণে রেখে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে এই দিনটি পালিত হয় সারা বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বের সকল মানুষকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সকল প্রকার সাফল্য বা অর্জন সম্পর্কে অবগত করতে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে পালন করা হয়।
বিশ্বশান্তি ও দারিদ্র্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বিশ্বের মোট ৫১টি স্বাধীন রাষ্ট্র একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে এই রাষ্ট্রসংঘ। সময়টা ছিল ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর। ৫১টি দেশ প্রথমে যোগদান করলেও এখন ১৮৮টি দেশ এই রাষ্ট্রসংঘের সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে একটি যুদ্ধজাহাজে মিলিত হন।
পরে ১৯৪৫ সালে তাঁরা ইয়াল্টায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের সঙ্গেও আলোচনা করেন। ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে একটি বৃহদায়তন সভায় রাষ্ট্রসংঘের জন্য একটি সনদ আইন প্রণয়ন করা হয়। এই সনদে রাষ্ট্রসংঘের কিছু নিয়মবিধি প্রস্তাবিত ছিল। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এই সংস্থার নাম দেন প্রথমে ‘জাতিসংঘ’ (League of Nations)।
সেই মতো ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর দিনটিতেই প্রথম রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ পাশ হয় এবং এই সনদে নিরাপত্তা কাউন্সিলের পাঁচজন স্থায়ী সদস্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাষ্ট্রপতিদের স্বাক্ষর সম্বলিত এই সনদ এই দিনেই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে ওঠেনি যেখানে রাষ্ট্রসংঘের মতো ঐতিহ্য, ব্যাপ্তি, সাংগাঠনিক পরিকাঠামো এবং প্রায়োগিক সাফল্য দেখা যায়।
মূলত চারটি লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয় রাষ্ট্রসংঘ – ১. সমগ্র বিশ্ব জুড়ে শান্তি ও স্থিতাবস্থা রক্ষা করা। ২. জাতি ও সম্প্রদায় সহ রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রাখা। ৩. দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা। ৪. সমস্ত প্রকার সমস্যা এবং প্রতিবন্ধকতায় যে কোনো রাষ্ট্রের পাশে কেন্দ্রীয় সহায়তা দান করা। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘ মোট ৫১টি শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
কম্বোডিয়া, এল সালভাদোর, গুয়াতেমালা, প্রাক্তন যুগোশ্লোভিয়া প্রভৃতি দেশে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগেই শান্তি নিশ্চিত হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরে এই রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত। যদিও পরবর্তীকালে ভিয়েনা ও জেনেভাতে এর কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রসংঘের নিজস্ব পতাকাও রয়েছে যেখানে দেখা যায় নীল রঙের কেন্দ্রে একটি সাদা প্রতীক যা আসলে জলপাই শাখায় জড়ানো বিশ্বের মানচিত্র।
এর অর্থ হল বিশ্বশান্তি সুরক্ষিত করা। এছাড়াও রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তরে গেলে এই সংস্থার সদস্যরূপ সকল দেশের পতাকা সজ্জিত থাকতে দেখা যায় বর্ণানুক্রমে। রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তরের এলাকাটির উপর কোনো একক দেশের মালিকানা নেই, এই এলাকাটি সঙ্ঘের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রক্ষা করে। ১৯৪৭ সালে প্রথম রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা ২৪ অক্টোবর দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘের জন্মবার্ষিকী হিসেবে ঘোষণা করে।
ঠিক এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতিক্রমে এই দিনটিতে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে রাষ্ট্রসংঘ দিবস। ১৯৫১ সালে এই দিনে রাষ্ট্রসংঘের ডাক-প্রশাসন বিভাগ প্রথম রাষ্ট্রসংঘের স্বতন্ত্র ডাকটিকিট প্রকাশ করে যা নিউইয়র্কে এই সংস্থার সদর দপ্তরে মার্কিন ডলারের উপর প্রকাশ পায় প্রথমে।
১৯৭১ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা সিদ্ধান্ত নেয় এই বিশেষ দিনটি পালিত হবে আন্তর্জাতিক ছুটির দিন হিসেবে এবং সেই মতো রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলিতে এই দিনটি সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হবে। কসোভোতে এই দিন সরকারিভাবে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ থাকে। এই দিনে প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রেই সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। ফিলিপিন্সে বিদ্যালয়যাত্রী শিশু-কিশোররা রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পোশাক পরে এক বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান করে।
ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই বিভিন্ন দেশের পতাকা নিজে হাতে তৈরি করে, শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, এমনকি বিভিন্ন খাবার সম্পর্কেও মানুষকে অবগত করায়। সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান এই দিনে বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকে। বিভিন্ন দেশে এই দিনকে উপলক্ষ করে খাদ্যমেলা আয়োজিত হয় যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের ভিন্ন ভিন্ন খাবারের পদ প্রদর্শিত হয়।
ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়গুলি তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে এই বৈচিত্র্যকে সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। ভারতে এই বিশেষ দিনে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের ছাদে ভারতের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ওড়ানো হয় রাষ্ট্রসংঘের পতাকা। যদিও ভারতের সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী রাজভবন, সংসদ ভবন কিংবা উচ্চ আদালতে এই রাষ্ট্রসংঘের পতাকা ওড়ানো হয় না। ২০২০ সালে ২৪ অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘ দিবসের ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপিত হয়েছে সাড়ম্বরে।
কোভিড মহামারীর প্রকোপের কারণে এই বিশেষ উদ্যাপনটি পুরোটাই আন্তর্জাল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর দিনটি একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে (Theme) সামনে রেখে উদ্যাপিত হয়। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রসংঘ দিবস এর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রতিপাদ্য ছিল ‘শক্তিশালী রাষ্ট্রসংঘ। উন্নত পৃথিবী’ (Strong UN. Better World)। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রসংঘ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল – সবার আগে স্বাধীনতা (Freedom First)। ২০১৭ সালে এই দিনের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা ও প্রতিভা’ (Potential in Diversity)।
তারপর ২০১৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ দিবসের প্রতিপাদ্য স্থিরীকৃত হয়েছিল – ‘শান্তি এবং অহিংসার ঐতিহ্য’ (Tradition Of Peace and Non-Violence)। ২০১৯ সালে বিশ্বের বিপন্ন পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্য রাখা হয় ‘আমাদের গ্রহ, আমাদের ভবিষ্যৎ’ (Our Planet, Our Future)। ২০২০ সালে ‘যে ভবিষ্যৎ আমরা চাই,
রাষ্ট্রসংঘের যা প্রয়োজন : বহুপাক্ষিকতার সাপেক্ষে সামগ্রিক প্রতিশ্রুতি সংগঠিত করা’ (The Future We Want, the UN We Need: Reaffirming our Collective Commitment to Multilateralism) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ দিবস । ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হল -স্থিতিশীল এবং যথার্থ বিশ্বের লক্ষ্যে ফিরে যাওয়া (Recovering better for an equitable and sustainable world)।