জুনাগড় সংযুক্তিকরণ এর অজানা ইতিহাস

জুনাগড় সংযুক্তিকরণ এর অজানা ইতিহাস

অখণ্ড ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পাশাপাশি কিছু কিছু দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যও ছিল। জম্মু ও কাশ্মীর, Junagadh জুনাগড়, ভোপাল, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যগুলিতে দেশীয় রাজারা শাসন করত ঠিকই, কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় প্রশাসনিক সুবিধের জন্য এই সব দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে।

দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় আঞ্চলিক পুনর্গঠনের। জম্মু ও কাশ্মীর, ভোপাল, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যগুলির মতো জুনাগড়েরও সংযুক্তিকরণ ঘটে সেই সময়। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি হয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে সেইসব দেশীয় রাজাদের যে চুক্তিকে আমরা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি হিসেবে জানি।

লর্ড ওয়েলেসলি প্রণীত এই নীতি অনুযায়ী ভারতের বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যকে কিছু বিশেষ শর্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে এই নীতি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। হায়দ্রাবাদের নিজাম প্রথম এই নীতিতে স্বাক্ষর করেন। সেই থেকে ভারতের মধ্যে একটি অন্যতম শক্তিশালী দেশীয় রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠেছিল হায়দ্রাবাদ। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, সেই সময় ভারতের মধ্যে এই দেশীয় রাজ্যগুলির পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসিত কিছু রাজ্য এবং কিছু কিছু পর্তুগিজ ও ফরাসি শাসিত অঞ্চল ছিল।

স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন কায়েম করার লক্ষ্যে রাজনৈতিকভাবে এই রাজ্যগুলিকে একত্রিত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার, ব্রিটিশ ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে একটিমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। এদিকে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক কোনো ঐক্য ছিল না। কোনও কোনও রাজ্যে মুসলিম শাসক ছিলেন আর সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারা ছিলেন হিন্দু। আবার কোনও কোনও রাজ্যে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে।

দেশীয় রাজ্যগুলির হিন্দু প্রজারা চাইতেন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে, কিন্তু মুসলিম শাসকেরা অনেকক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন শর্ত দিয়েছিলেন যে, ভারতের সকল দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা আবশ্যিক। ফলে এক এক দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এক এক প্রকারের সমস্যা দেখা দেয়।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন’ অনুযায়ী বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও হায়দ্রাবাদ, জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড় প্রভৃতি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে সমস্যা দানা বাঁধে। সৌরাষ্ট্রের উপকূল অঞ্চলে জুনাগড় একটি ছোট্ট রাজ্য। ভৌগলিকভাবে জুনাগড় এমনভাবে ভারতীয় মানচিত্রের মধ্যে অবস্থিত ছিল যে কোনওভাবেই পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া তার পক্ষে ভৌগলিকভাবে সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানের সঙ্গে কোনওভাবেই নৈকট্য গড়ে তোলা জুনাগড়ে অসম্ভব ছিল।

আর এই রাজ্যের প্রজারা সকলেই হিন্দু হওয়ার সুবাদে ভারতের সঙ্গেই সংযুক্ত হতে চেয়েছিলেন তারা। কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে অবস্থিত এই জুনাগড়ের আশেপাশের সব রাজ্যই ততদিনে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। জুনাগড়ের তৎকালীন নবাব মহবতখান রসুলখানজি পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন জুনাগড়কে। এই জুনাগড়েই আবার ভারভারা বন্দরের কাছে অবস্থিত সোমনাথ হিন্দু মন্দির মহম্মদ গজনী ধ্বংস করেছিলেন। ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এখানে খুবই স্পর্শকাতর অবস্থায় ছিল।

-১৯৪৭ সালের মে মাস নাগাদ জুনাগড়ের দেওয়ান শাহনাওয়াজ ভুট্টোর পরামর্শেই জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পক্ষ থেকে তৎকালীন রাজ্য মন্ত্রকের সম্পাদক ভি. পি. মেনন জুনাগড়ের নবাব মহবত রসুলখানজিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অনুরোধ করলেও নবাব রাজি হননি। ইতিমধ্যে জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানের করাচিতে গণপরিষদে প্রতিনিধির হাত দিয়ে পাঠান এবং মহম্মদ আলি জিন্না সেই চুক্তিপত্রে সম্মতি-স্বাক্ষর করেন।

ফলে পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও জুনাগড়ের মানুষেরা এর প্রতিবাদ জানায়। ভৌগোলিক অবস্থান কিংবা জনগণের স্বাধীন চিন্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে সেই সময় মহম্মদ আলি জিন্না ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসানের ফলে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত বা পাকিস্তানে দ্রুত অন্তর্ভুক্তিতে জোর দিতে থাকে। এর ফলে স্বাধীনতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে যে স্বাধীনতা মানে কি তাহলে ক্ষমতার বৈধ হস্তান্তরমাত্র? ১৯৪৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভি. পি. মেনন জুনাগড়ে গিয়ে দেওয়ান শাহনাওয়াজ ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ভুট্টো এতে অসম্মত হন।

মেননের পরামর্শে মহাত্মা গান্ধীর ভাইপো সমলদাস গান্ধী ২৫ সেপ্টেম্বর নাগাদ জুনাগড়ের মধ্যেই রাজকোট শহরে নবাবের বিরোধিতা করে ‘আর্জি হুকুমত’ নামে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসংঘের সভায় নেহেরু সমলদাস গান্ধীর সঙ্গে ভারত সরকারের সকল সংযোগ অস্বীকার করেন। পাকিস্তানের মহম্মদ আলি জিন্নাহকে চিঠি লিখে নেহরু জানান যে, এই ঘটনায় তাঁর কোনও হস্তক্ষেপ নেই, বরং জুনাগড়ের স্থানীয় মানুষের বিক্ষোভের পরিণাম এই অস্থায়ী সরকার গঠন।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মনে করেছিলেন যে জুনাগড়কে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে দিলে গুজরাতের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব চরমে উঠবে। নবাবের মত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশেষে জুনাগড়কে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কাথিয়াওয়াড়ের অন্যান্য অঞ্চলেরও সহায়তা ছিল এই কাজে। এর ফলে জুনাগড়ে সমস্ত খাদ্যপণ্যের সরবরাহও বন্ধ হয়। এমতাবস্থায় জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং রাজ্যের শাসন ন্যস্ত হয় শাহনাওয়াজ ভুট্টোর উপর।

ভুট্টো পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহায়তার জন্য নভেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, কিন্তু কোনও সাহায্যই আসে না। জুনাগড়ের অস্থায়ী সরকার, দেশের হিন্দু জনগণ সকলে মিলে নবাব ও দেওয়ানের বিরোধিতা শুরু করলে ৬৭০ জন মুসলিম প্রজাদের একটি সেনাদল সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনা বুঝতে পেরে দেওয়ান শাহনাওয়াজ ভুট্টো পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড়ে প্রবেশ করে শান্তিস্থাপনের জন্য জুনাগড়ের প্রশাসনিক অধিকার ও কর্তৃত্ব দখল করে।

১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর জুনাগড়ের অধিকার দখল করলে লিয়াকৎ আলি খানকে নেহেরু একটি টেলিগ্রামে এই সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন যার উত্তরে লিয়াকৎ আলি খান জুনাগড়ে ভারতীয় সেনা মোতায়েন করার তীব্র নিন্দা করে পাকিস্তানের সীমা লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের প্রশ্ন তোলেন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। ঠিক এই সময়েই বহু মুসলিম জনগণের হত্যা, লুঠ ও নারী ধর্ষণের অভিযোগ আসছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে।

ফলে ভারত সরকার প্রশাসনিক অধিকার দখল করলেও পাকিস্তানের সঙ্গে জুনাগড়ের যে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি তা প্রত্যাহার করেনি। রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে গণভোটের আয়োজন হয় জুনাগড়ে যেখানে ৯৯ শতাংশ জনগণ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হুয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত জুনাগড় বম্বের অন্তর্ভুক্ত সৌরাষ্ট্রের অধীনস্থ একটি রাজ্য হিসেবেই থাকে। ১৯৬০ সালে বম্বেকে ভাষাগত দিক থেকে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে বিভক্ত করে দেওয়া হলে গুজরাতের অভ্যন্তরে সৌরাষ্ট্রের একটি জেলা হিসেবে জুনাগড় গড়ে ওঠে।