উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এর জীবনী

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এর জীবনী

দুরারোগ্য ব্যাধি কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যে বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী, তিনি উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (Upendranath Brahmachari)। একইসঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও তাঁর।কলকাতায় তাঁর উদ্যোগের মধ্য দিয়েই চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সেনা ছাউনির সেনারা সেদিন এই বাঙালির আবিষ্কৃত ওষুধেই জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। তিনি শুধু পণ্ডিত গবেষক বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একইসঙ্গে সচেতন নাগরিকও ছিলেন।

প্রতিভাধর, কর্মে নিরলস, চূড়ান্ত অধ্যবসায়ী বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী তাঁর কষ্টসাধ্য গবেষণার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু মানবসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিহারের মুঙ্গের জেলার জামালপুরে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম হয়।তাঁর বাবার নাম নীলমণি ব্রহ্মচারী এবং মায়ের নাম সৌরভ সুন্দরী দেবী। তাঁর বাবা ছিলেন পূর্ব ভারতীয় রেলের একজন ডাক্তার। সেইসময় জামালপুর ছিল বিখ্যাত রেলওয়ে জংশন স্টেশন। জামালপুরের ইউরোপীয় কিংবা ভারতীয় প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বাঙালি ডাক্তার হিসেবে তাঁর বাবার খুব নামডাক ছিল।

রেলের চিকিৎসকের চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে তিনি মিউনিসিপ্যাল কমিশনার এবং পরে হুগলি জেলার ‘অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট’ (Honourary Magistrate) পদে বহাল ছিলেন। উপেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল জামালপুরের ‘ইস্টার্ন রেলওয়ে বয়েজ হাই স্কুল’-এ।

গণিত এবং রসায়নে তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। হুগলি মহসিন কলেজ থেকে গণিত এবং রসায়নে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক উত্তীর্ণ হন ১৮৯৩ সালে। সেসময় দুটি বিষয়ে একত্রে স্নাতক পড়া যেত। ১৮৯৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চতর রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।প্রেসিডেন্সিতে তাঁর রসায়নের শিক্ষক ছিলেন স্যার আলেকজান্ডার পেডলার এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বয়ং। প্রফুল্লচন্দ্রের অনুপ্রেরণা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তারপর মেডিকেল কলেজ থেকে ১৮৯৮ সালে এলএমএফ (L.M.F) এবং ১৮৯৯ সালে সেখান থেকেই ভেষজবিজ্ঞান এবং শল্যচিকিৎসায় এমবি (M.B) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন।

এজন্য তিনি গুডিভ ও ম্যাকলয়েড পদক (Goodeve & Mcleod Medal) পান। শরীরতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন উপেন্দ্রনাথ ১৯০২ সালে, একই বছরে এমডি (M.D) ডিগ্রিও লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার মূল বিষয় ছিল – রক্তের লোহিতকণিকার ভাঙন।উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে  ব্রিটিশ সার্জন ও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল স্যার জেরাল্ড বমফোর্ডের (Jerald Bomford) অধীনে। উপেন্দ্রনাথের প্রতিভায় এবং নতুন গবেষণার আগ্রহে মুগ্ধ হয়ে বমফোর্ড ১৯০১ সালে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে শরীরতত্ত্ব, মেটেরিয়া মেডিকার শিক্ষক এবং চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করেন।

ঢাকায় তিনি মাত্র চার বছর ছিলেন। কলকাতায় ফিরে ১৯০৫ সালে তিনি ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে মেডিসিন-শিক্ষক এবং ‘ফার্স্ট-ফিজিশিয়ান’ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। এই স্কুলটি এখন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে পরিচিত। এই স্কুলেই জীবনের ২০টি গুরুত্বপূর্ণ বছর কাটিয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ।স্কুলের সুপারিনটেন্ডেণ্ট স্যার নিল ক্যাম্পবেলের (Neil Campbell) অধীনে তিনি গবেষণার সুযোগও পেয়েছিলেন। এখানেই ২০ বছরের অধ্যাপনা ও গবেষণাকালে আবিষ্কার করেন কালাজ্বরের যুগান্তকারী ওষুধ। ১৯২৩-এ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অতিরিক্ত চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন।

১৯২৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে উপেন্দ্রনাথ কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে ‘ট্রপিক্যাল ডিজিজ্‌’ (Tropical Disease) বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। এছাড়া ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট-এর ট্রপিক্যাল ডিজিজ্‌ ওয়ার্ডের ইন-চার্জ পদেও তিনি কাজ করেছেন।সবশেষে কলকাতার ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স-এর বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সাম্মানিক অধ্যাপক পদেও বহাল ছিলেন এই মহান মানুষটি। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ‘কালাজ্বর’-এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা।

 কালা জ্বর যা ইংরেজিতে Visceral leishmaniasis, Sahib’s disease, Dumdum fever, Black fever নামে পরিচিত৷ এটি একটি রোগ যা লিশম্যানিয়াসিস রোগের কয়েকটি প্রকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর। লিশম্যানিয়া এক প্রকার প্রোটোজোয়া পরজীবী যে এই রোগটি ঘটায় এবং বেলেমাছির কামড়ের দ্বারা এটি বিস্তার লাভ করে।

পরজীবী-ঘটিত রোগগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয় প্রাণঘাতী রোগ; ম্যালেরিয়ার পরেই এর স্থান। লিশম্যানিয়াসিসে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।এই পরজীবীটি মানুষের কলিজা, প্লীহা ও অস্থিমজ্জাতে সংক্রমণ ঘটায় এবং চিকিৎসা না করালে মৃত্যু প্রায় অবধারিত।এই রোগের লক্ষণ হলো, জ্বর, ওজন হ্রাস, ক্ষত, অবসাদ, রক্তাল্পতা, চামড়া কালচে হওয়া এবং হৃদ্‌পিণ্ড ও প্লীহার আকার বৃদ্ধি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রোগটি আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে এটি ব্যাপকভাবে দেখা যায়। 

১৯০২ সালে যখন গোটা বিশ্বজুড়ে কালাজ্বরের প্রভাব থাবা বসিয়েছে, গ্রামের পর পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের ফারাকই করতে পারছেন না চিকিৎসকরা। ব্রাজিল, ইতালিতে শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। স্যার লিওনার্ড রজার্স কালাজ্বর নিয়ে তাঁর গবেষণা শুরু করেন।ভারতবাসীর উপরে পটাসিয়াম থেকে তৈরি টারটার এমেরিক প্রয়োগ করা হলে শুরু হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ইতালির ডাক্তাররা দাবি করেন, অ্যান্টিমোনাইল পটাসিয়াম টার্টারেট প্রয়োগ করে সে দেশে ভালো ফল মিলেছে। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ জানতেন যে ভারতে এই ওষুধ কার্যকরী হবে না।

ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে তাঁর নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতেই গবেষণা শুরু করলেন উপেন্দ্রনাথ। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারক নোবেলজয়ী স্যার রোনাল্ড রসকে কালাজ্বর কমিশনের অধিকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হলেও তিনি এর প্রতিকার করতে পারেননি। কুইনাইনের দ্বারা এই রোগ সারেনি বলে ম্যালেরিয়া থেকে যে এই রোগ আলাদা তা তিনি ঘোষণা করেছিলেন।

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ইতালির ডাক্তারদের ব্যবহৃত পটাশিয়ামের বদলে সোডিয়াম ব্যবহার করে পরীক্ষা চালালেন। সেসময় আর্সেনিক অ্যান্টিমনি ব্যবহৃত হত সি-সিকনেস, আফ্রিকান স্লিপিং ডিজিজ্‌—র প্রতিকারে। তিনি পরীক্ষা শুরু করেন সোডিয়াম অ্যান্টিমনি টার্টারেট নামক সংকর যৌগ নিয়ে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

তখন ধাতব অ্যান্টিমনি নিয়ে আরো গভীর গবেষণায় রত হন তিনি। ধাতব অ্যান্টিমনি সেসময় সহজলভ্য ছিল না, প্রতিবার নিজেকেই তৈরি করে নিতে হত। তাছাড়া দীর্ঘ সময়ের জন্য সেটি সংরক্ষণ করে রাখা যেত না। তার উপর ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের ছোট্ট ঘরে তখন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, জলের পাম্প নেই, সরঞ্জামও নিতান্তই সামান্য।

আর্থিক অনুদানও মেলেনি। তবে তাঁর জেদ ও অধ্যবসায়ের কাছে হার মেনেছিল সমস্ত প্রতিকূলতা। ১৯১৯ সালের শেষদিকে তিনি ‘ইণ্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড অ্যাসোসিয়েশন’ এর পক্ষ থেকে কিছু অনুদান পান এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের বৃহত্তর গবেষণার জন্য।অবশেষে একদিন তিনি তৈরি করে ফেলেন ইউরিয়া স্টিবামাইন যা কিনা আসলে প্যারা-অ্যামাইনো ফিনাইল স্টিবনিক অ্যাসিডের (Para-amino phenyl stibnic acid) ইউরিয়া লবণ। প্রথমে খরগোশের উপর প্রয়োগ করে সুফল মিললে মানুষের উপর প্রয়োগ করেন তিনি।

এবারেও ফল ভালোই হয়। সালটা ১৯২০, তৈরি হল এভাবেই কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন। ১৯২২ সালে ক্যাম্পবেল ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কালাজ্বর রোগীদের ওপর ইউরিয়া স্টিবামাইনের প্রয়োগ করেন উপেন্দ্রনাথ। দেখা যায়, মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনওরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগ নিরাময় সম্ভব হচ্ছে।

পর পর ন’জন রোগীকে সুস্থ করে তোলে উপেন্দ্রনাথের প্রতিষেধক। ১৯২২ সালেই ‘ইণ্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ’-এ ৮ জন কালাজ্বর রোগীকে সুস্থ করার বিবরণ সহ উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে ‘ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট’-এ ইউরিয়া স্টিবামাইন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশিত হয়।

উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন অসমের গর্ভনর স্যার জন খের। তিনি বললেন, এক বছরে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ইউরিয়া স্টিবামাইন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রিস, ফ্রান্স, চিন-সহ কিছু কিছু দেশেও এই প্রতিষেধকের প্রয়োগ শুরু হয়।

কালাজ্বরে মৃত্যুর হার নেমে এল ৭ শতাংশে। কালাজ্বর ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি নিয়েও গবেষণা করেছিলেন । কালাজ্বরের ওষুধের উপর তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ‘কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’ থেকে মিন্টো পদক পান উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ।

‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ তাঁকে ‘স্যার উইলিয়াম জোন্‌স’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাছাড়া তিনি ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য পরপর দু’বার নোবেল সম্মানের জন্য মনোনয়ন জমা পড়লেও, উপেন্দ্রনাথ কোন এক অজানা কারণে নোবেল পাননি।

এছাড়াও তিনি ব্রিটিশ সরকারের থেকে ‘রায়বাহাদুর’ এবং ‘নাইটহুড’ উপাধি লাভ করেন। দেশীয় ওষুধ তৈরির জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এ বহু তরুণ বিজ্ঞানী নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন এখনো মানুষের সেবার লক্ষ্যে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর লেখা বই ‘ট্রিটিজ অন কালাজ্বর’ (Treatise on Kala-Azar) বিখ্যাত।উপেন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের র‌য়্যাল সোসাইটি অফ মেডিসিনের সভ্য, ইন্দোরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি এবং নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।  ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মৃত্যু হয়।

আরো পড়ুন

জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা