বিক্রম বাত্রা এর জীবনী

বিক্রম বাত্রা এর জীবনী

ভারতের ইতিহাসে সবথেকে বড়ো যুদ্ধ বলতে ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের কথাই বলতে হয় আর এই যুদ্ধেই উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ‘পরমবীর চক্র’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা (Vikram Batra)। ভারতের সবথেকে সম্মানীয় শৌর্য-বীর্যের প্রতীক এই পরমবীর চক্র। কার্গিল যুদ্ধের সময় জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় সতেরো হাজার ফুট উঁচুতে পয়েন্ট ৫১৪০ স্থানটি পাকিস্তানি সৈন্যদের দখল থেকে মুক্ত করে প্রবল সাহসিকতা এবং দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

তাঁর অনবদ্য শৌর্যের কারণে তাঁকে অনেকে ‘শেরশাহ’ বলেও ডাকতেন। আর ঠিক এই নামেই তাঁকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে ওটিটি(OTT) প্ল্যাটফর্মে। ১৯৭৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হিমাচল প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর পালামপুরে বিক্রম বাত্রার জন্ম হয়। তাঁর বাবা গিরিধারীলাল বাত্রা স্থানীয় স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং তাঁর মা কমল কান্ত বাত্রা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা। তাঁদের দুই যমজ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন বিক্রম। বিক্রম বাত্রা এবং বিশাল বাত্রা এই দুই ভাইকে ছোটোবেলায় লব আর কুশ বলে ডাকা হতো।

সীমা এবং নূতন নামে বিক্রমের দুই বোনও ছিল। মায়ের কাছেই বিক্রম বাত্রার প্রাথমিক শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে। তারপর তিনি ভর্তি হন পালামপুরের দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে। ঐ স্কুলে মধ্যম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পরবর্তীকালে তিনি পালামপুরের সেন্ট্রাল স্কুলে ভর্তি হন এবং সেন্ট্রাল স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষালাভ করেন।

পড়াশোনায় মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি বিক্রম বাত্রা একজন খেলোয়াড় ছিলেন এবং দিল্লিতে আয়োজিত যুব সংসদীয় প্রতিযোগিতায় জাতীয় স্তরে তিনি নিজের স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। টেবিল টেনিস, ক্যারাটে সহ আরো অনেকে খেলায় তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন এবং এই খেলাগুলিতেই তিনি নিজের স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৯০ সালে তিনি এবং তাঁর ভাই দুজনেই সর্বভারতীয় কেভিএস জাতীয় প্রতিযোগিতায় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ক্যারাটেতে তাঁর গ্রিন বেল্ট ছিল। মানালিতে আয়োজিত জাতীয় স্তরের ক্যারাটে ক্যাম্পেও অংশ নিয়েছিলেন বিক্রম বাত্রা।

১৯৯২ সালে সেন্ট্রাল স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চণ্ডীগড়ের দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজে ভর্তি হন তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়বেন বলে। কলেজের প্রথম বর্ষে পড়াকালীন বিক্রম এনসিসি-র বায়ুশাখায় যোগ দেন। আন্তঃরাজ্য এনসিসি ক্যাম্প চলাকালীন পাঞ্জাব ডিরেক্টোরেটের অধীনে উত্তর অংশের সেরা এনসিসি বায়ুশাখার ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হন বিক্রম বাত্রা।

তারপর চল্লিশ দিন ব্যাপী তিনি তাঁর এনসিসি বায়ুশাখার সঙ্গে চণ্ডীগড় থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পিঞ্জোর এয়ারফিল্ড অ্যাণ্ড ফ্লাইং ক্লাবে প্যারাট্রুপিং-এর প্রশিক্ষণ নেন। ডিএভি কলেজে পড়াকালীন তিনি ঐ কলেজের ইউথ সার্ভিস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৪ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে একজন এনসিসি ক্যাডেট হিসেবে তিনি যোগদান করার সুযোগ পান আর এই ঘটনার ফলেই তাঁর মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে প্রবলতর হয়।

১৯৯৫ সালে কলেজে পড়াকালীনই একটি জাহাজ কোম্পানি যাদের প্রধান দপ্তর রয়েছে হংকং-এ সেখান থেকে মার্চেন্ট ন্যাভি পদে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। কিন্তু সেই আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে বিক্রম বাত্রা ১৯৯৫ সালে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ‘কম্বাইণ্ড ডিফেন্স সার্ভিসেস’ পরীক্ষায় পাশ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন ক্লাস করার পাশাপাশি তিনি সকালে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে আংশিক সময়ের জন্য কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে সিডিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এলাহাবাদে সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পান তিনি। স্নাতকোত্তর স্তরে এক বছর পরার পরে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বিক্রম বাত্রা ‘ইণ্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি’তে যোগ দেন।

১৯৯৬ সালে দেরাদুনে মানেক্‌শ-এর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতেই প্রকৃত কর্মজীবন শুরু হয় বিক্রম বাত্রার। ১৯ মাসের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে বিক্রম বাত্রা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্টের পদে আসীন হন। জম্মু এবং কাশ্মীর রাইফেলস্‌-এর তেরোতম ব্যাটেলিয়ানে তাঁকে নিয়োগ করা হয় এবং মধ্যপ্রদেশের জাবালপুরে রেজিমেন্ট প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় বিক্রম বাত্রাকে।

সমস্ত প্রশিক্ষণ শেষ করে তাঁর প্রথম নিয়োগ ঘটে জম্মু-কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলার সোপোরে যে জায়গাটা অনুপ্রবেশকারীদের অতর্কিত হামলার জন্য কুখ্যাত ছিল। তাঁর প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এই সোপোরেই একদিন এক গুরুতর মোকাবিলার সময় শত্রুপক্ষের গুলিতে মারা যায় তাঁর এক সহযোদ্ধা। তাঁরই প্রাণ যাওয়ার কথা ছিল ঐ গুলিতে কিন্তু কোনোক্রমে তিনি বেঁচে যান।

১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে কর্ণাটকের বেলগাঁওতে কমাণ্ডো কোর্সের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে যান তিনি। আর এই প্রশিক্ষণের শেষে বিক্রম বাত্রা ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্দেশক পদে আসীন হন বিক্রম। ঠিক এই সময়েই শুরু হয়ে যায় কার্গিল যুদ্ধ। টলোলিং পর্বতে আক্রমণের সময় রাজপুতানা রাইফেলস ব্যাটেলিয়ানকে সহায়তা করার দায়িত্বে ছিল বিক্রম বাত্রার ১৩ জেএকে রাইফেলস।

রাজপুতানা রাইফেলস প্রায় চারবারের চেষ্টায় টলোলিং চূড়া দখল করলে ক্রমে বিক্রম বাত্রা তাঁর ব্যাটেলিয়ান নিয়ে দ্রাসের দিকে এগিয়ে যান। ক্রমেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ে যুদ্ধঘোষণা করছিল। প্রত্যক্ষ সংঘাতের ডাক দেন বিক্রম বাত্রা। ১৩ জেএকে রাইফেলস-এর প্রচেষ্টায় ঐ অঞ্চলে পয়েন্ট ৫১৪০ চূড়াটি দখল করে নেন বিক্রম বাত্রা। ধীরে ধীরে প্রবল বীরত্ব এবং সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা একে একে ৫১০০, ৪৭০০, থ্রি পিম্পল কমপ্লেক্স ইত্যাদি সব পয়েন্ট গুলোই দখলে নিয়ে আসে।

পয়েন্ট ৫১৪০ জয় করার জন্য সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন পদে উত্তীর্ণ হন বিক্রম বাত্রা। এরপরের লক্ষ্য ছিল ৪৮৭৫ পয়েন্টটি অধিকার করা। কিন্তু এর জন্য সবথেকে বড়ো বাধা হল ১ নং জাতীয় সড়ক একেবারে খোলামেলাভাবে পেরোতে হতো যার ফলে খুব সহজেই পাকিস্তানি সৈন্যদের নজরে আসতে পারতেন ভারতীয় সেনারা। প্রায় ৩৫-৪০ কিলোমিটারের রাস্তা এভাবে অসুরক্ষিতভাবে পেরোনো খুব একটা সহজ ছিল না। অসুস্থ শরীর নিয়েও সারা রাত যুদ্ধ করতে হয়েছে বিক্রম বাত্রাকে, অবশেষে ভারতীয় সেনারা জয় করতে পেরেছে পয়েন্ট ৪৮৭৫।

কিন্তু হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণ চালায়, আহত হন ঐ এলাকার তদানীন্তন দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এন .এ .নাগাপ্পা। ক্রমেই আরো নানাদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে শত্রুরা। এই পরিস্থিতিতে ৬ জুলাই বাত্রা এবং তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা নিকটবর্তী দুর্গা মন্দিরে প্রার্থনা জানিয়ে তাদের অভিযান শুরু করে দেন। যদিও এই অভিযান ছিল নিয়মবিরুদ্ধ।

সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, চারজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে ৭ জুলাই ধীরে ধীরে ঐ অঞ্চলের এরিয়া ফ্ল্যাট টপ ভারতের অধিকারে নিয়ে আসেন বাত্রা। ঠিক এইসময় একজন অসুস্থ সৈনিককে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়েই শত্রুপক্ষের স্নাইপারের গুলি সোজা এসে তাঁর বুক ফুঁড়ে দেয় এবং পোড় মুহূর্তেই আরপিজি বন্দুক থেকে ছোঁড়া গ্রেনেড তাঁর সামনে এসে পড়ে এবং বিস্ফারিত গ্রেনেডের স্প্লিনটার তাঁর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়।

বাত্রা তাঁর পাশে থাকা আহত এক সেনার গায়ে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়/ ১৯৯৯ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের ৫২তম স্বাধীনতা দিবসে বিক্রম বাত্রাকে ভারত সরকার দেশের সবথেকে সম্মানীয় পুরস্কার শৌর্য-বীর্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পরমবীর চক্র প্রদান করে। বিক্রম বাত্রার পক্ষ থেকে তাঁর বাবা গিরিধারীলাল বাত্রা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে. আর. নারায়ণনের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে।

‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’ স্লোগানটি আমরা অনেকেই পেপসি কোম্পানির বিজ্ঞাপনী প্রচারের অঙ্গ হিসেবে শুনে থাকি, কিন্তু অনেকেই জানেননা এই স্লোগানটির প্রকৃত জনক বিক্রম বাত্রা স্বয়ং। ৪৮৭৫ পয়েন্ট অধিকার করার পরে অভিযানের সাফল্যে উল্লসিত বিক্রম বাত্রা প্রথম এই কথাটি বলেছিলেন। তাঁর সফল অভিযানকে স্মরণে রেখে ভারতীয়দের অধিকারে ফিরে আসা পয়েন্ট ৪৮৭৫ যে পর্বতের অংশ তার চূড়ার নাম রাখা হয় ‘বাত্রা টপ’।

তাঁর স্মরণে এলাহাবাদে সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের প্রেক্ষাগৃহের নাম রাখা হয় ‘বিক্রম বাত্রা ব্লক’। এমনকি জাবালপুর সেনানিবাসের আবাসিক অংশের নামও তাঁর নামে রাখা হয় ‘ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা এনক্লেভ’। পালামপুর গভর্নমেন্ট কলেজ তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা গভর্নমেন্ট কলেজ, পালামপুর’ নামে পরিচিত হয়। এমনকি পালামপুর স্টেডিয়ামটিরও নাম পরিবর্তন করে শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা স্টেডিয়াম রাখা হয়।