ভ্লাদিমির পুতিন এর জীবনী

ভ্লাদিমির পুতিন এর জীবনী

রাশিয়ার গোয়েন্দাবিভাগ কেজিবি-র প্রাক্তন ফরেন ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনপ্রিয় ও বিশ্বখ্যাত ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin)। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন তিনি। ২০০০ সালে রাশিয়ার পূর্বতন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলস্টিনের পদত্যাগের পরে তিনিই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন।

২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকার পরে ২০১২ সালে পুনর্নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৮ সালে আবার ৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন তিনি এবং আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনিই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট থাকবেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনিই প্রথম একজন ক্রেমলিন নেতা হিসেবে ইসরায়েল পরিদর্শনে যান ২০০৫ সালে আর এটাই ছিল তাঁর ঐতিহাসিক ভ্রমণ।

২০১৪ সাল নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রথম পর্যায়েই তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় ও নেতৃত্বে রাশিয়ার অর্থনীতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে এবং দেশের জিডিপি, ক্রয়ক্ষমতার পাশাপাশি মানুষের উপার্জন সবই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য প্রায় অর্ধেক হ্রাস পায়।

বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সবথেকে বেশিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিরোধীদের দমন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো কিছু অভিযোগ উঠে আসে বুদ্ধিজীবী মহলে। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের লেনিনগ্রাদে ভ্লাদিমির পুতিনের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ্‌ পুতিন।

তাঁর বাবা ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ্‌ পুতিন সোভিয়েত নৌ-বাহিনীর একজন কর্মী ছিলেন এবং তাঁর মা মারিয়া ইভানোভনা পুতিনা ছিলেন একটি কারখানার শ্রমিক। তাঁদের তিনটি সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর ঠাকুরদাদা স্পিরিদোন পুতিন ভ্লাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিগত রাঁধুনি ছিলেন। তাঁর দুই দাদাই ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত দেশের সাবমেরিনে কর্মরত ছিলেন তিনি এবং পরে তাঁকে সাধারণ সেনাবাহিনীতে বদলি করে দেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে তিনি প্রচণ্ড আহত হয়ে ফিরে আসেন, ভ্লাদিমির পুতিনের দিদাকে জার্মান অনুপ্রবেশকারীরা হত্যা করে। ঐ সময়েই ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাঁর দাদা ভিক্টর। ১৯৬০ সালে ১ সেপ্টেম্বর তারিখে ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বাড়ির কাছে বাস্কোভ লেনে ১৯৩ নং স্কুলে ভর্তি হন। ১২ বছর বয়সে তিনি সাম্বো ও জুডো শিখতে শুরু করেন।

এরপর সেন্ট পিটার্সবার্গ হাইস্কুলে তিনি জার্মান ভাষা শিখে ফেলেন। লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি (অধুনা সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি) থেকে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন ১৯৭৫ সালে। কলেজে পড়াকালীন তিনি একটি গবেষণাপত্র লেখেন যার বিষয় ছিল ‘মোস্ট ফেভারড নেশন ট্রেডিং প্রিন্সিপ্‌ল’। এই সময়েই ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি সদস্যপদ ত্যাগ করেননি।

১৯৭৫ সালে রাশিয়ার বিখ্যাত গোয়েন্দা বিভাগ কেজিবি-তে যোগ দেন ভ্লাদিমির পুতিন। প্রথমে লেনিংরাদের ওখতায় ৪০১তম কেজিবি স্কুলে তাঁর প্রশিক্ষণ হয় এবং প্রশিক্ষণের পরে তিনি ফার্স্ট চিফ্‌ ডিরেক্টোরেট পদে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে পুতিনকে মস্কোতে ‘ইউরি অ্যাণ্ড্রোপভ রেড ব্যানার ইন্সটিটিউট’-এ পাঠানো হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে একজন অনুবাদকের ছদ্ম-পরিচয়ে কর্মরত ছিলেন। কেজিবি থেকে অবসর গ্রহণের সময় তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে আসীন ছিলেন। এরপর দেশে ফিরে লেনিনগ্রাদ ইউনিভার্সিটির একটি প্রশাসনিক পদে যোগ দেন পুতিন। ১৯৯১ সালে কমিউনিজমের পতন ঘটলে উদারপন্থী রাজনীতিবিদ অ্যানাতোলি সোবচাকের পরামর্শদাতা হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরে অ্যানাতোলি লেনিনগ্রাদের মেয়র নির্বাচিত হলে ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর এক্সটার্নাল রিলেশন অফিসের মুখ্য কার্যনির্বাহী নিযুক্ত হন।

১৯৯৪ সালে পুতিন মেয়র অ্যানাতোলি সোবচাকের প্রথম ডেপুটি মেয়রের পদে উন্নীত হন। ১৯৯৬ সালে সোবচাকের পরাজয়ের পরে পুতিন পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মস্কোয় চলে যান। সেখানে বরিস ইয়েলস্টিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে ‘ডেপুটি হেড অফ ম্যানেজমেন্ট’ পদে যোগ দেন পুতিন। এই পদে তাঁর দায়িত্ব ছিল আঞ্চলিক সরকারের সঙ্গে ক্রেমলিনের সম্পর্ক বজায় রাখা। এর কিছুদিনের মধ্যেই পুতিনকে প্রাক্তন কেজিবির শাখারূপ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের মুখ্য পদে নির্বাচিত করা হয়।

এরপরেই ইয়েলস্টিন তাঁর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিলে সেই পদে আসীন হন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুতিন নির্বাচিত হন, তখনও গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়নি। ২০০০ সালের মার্চ মাসে ৫৩ শতাংশ ভোটে জিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়ে প্রথম পর্যায়েই তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ও প্রশাসনিক দক্ষতায় রাশিয়ার জিডিপি, ক্রয়ক্ষমতা এবং মানুষের ব্যক্তিগত উপার্জন অনেকাংশে বেড়ে যায়।

রাশিয়ায় এই সময় বেকারত্ব ও দারিদ্র্য প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। বিভিন্ন সত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারসাধনের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার বড়ো বড়ো ধনী নাগরিকে ব্যবসায়িক লেনদেনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন পুতিন। শেশ্‌ন্যায়ে (Chechnay) রাশিয়ার মিলিটারি প্রচার অটুট রাখেন তিনি। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস-প্রতিরোধী প্রচারের সহায়ক হিসেবে মার্কিন প্রদেশের সহায়তায় এগিয়ে আসে রাশিয়া। কিন্তু যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রেক্ষিতের অভিমুখ বদলে সন্ত্রাসের দায়ভার ইরাকি নেতা সাদ্দাম হুসেনের উপর চাপিয়ে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত হয়,

সেই সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে পুতিন এই কাজের বিরোধিতা করে জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডার এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাকুইস চির‍্যাকের সঙ্গে যোগ দেন। ২০০৪ সালে পুতিন রাষ্ট্রপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হন এবং এই বছরই এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে এক ঐতিহাসিক সফরে যান। একজন ক্রেমলিন নেতা হিসেবে পুতিনই প্রথম ইসরায়েলের সফরে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ২০০৮ সালে তাঁর রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষ হলেও তাঁর পরবর্তী রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেডভেডেভ পুতিনকে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন এবং আগামী চার বছরের জন্য দেশের এক উচ্চতম প্রশাসনিক পদেই বহাল রাখেন।

২০১২ সালে ৪ মার্চ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বার নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। শাসনক্ষমতা লাভ করে মেডভেডেভকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত করেন। এই সময় তাঁর বিরুদ্ধে যদিও নির্বাচনী দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু তাতে জনমানসে খুব একটা বিরূপ প্রভাব পড়েনি। এতটাই প্রভাবশালী জনপ্রিয়তা ছিল ভ্লাদিমির পুতিনের। রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিসমূহে কিছু বিতর্কিত পরিবর্তন করেছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পুতিন একটি আইনে স্বাক্ষর করে বৈধতা দেন যাতে মার্কিন জনগণকে রাশিয়ান শিশুকে দত্তক নেওয়া থেকে বিরত করা হয়। পুতিনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

পুতিনের বক্তব্য ছিল এই আইনের ফলে রাশিয়ানরা নিজেরাই দেশের শিশুদের দত্তক নিতে সমর্থ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এডওয়ার্ড স্নোডেনকে জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের মিছু গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত করেছিল মার্কিন সরকার, সেই এডওয়ার্ড স্নোডেনকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে সেই বছরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর সঙ্গে স্থিরীকৃত সাক্ষাৎ বাতিল করে দেন। এই সময় সমকামিতা-বিরোধী আইন পাশ করার ফলে পুতিন বহু মানুষের বিরাগভাজন হন।

২০১৩ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সিরিয়ার মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে মার্কিন প্রদেশের আগ্রাসী মনোভাবের সমালোচনা করেন ভ্লাদিমির পুতিন। এর পরের বছর ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের সময় পুতিন আশ্বাস দেন যে অলিম্পিকে যোগদানকারী বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতি বিশেষে সকল অ্যাথলিটকেই সুরক্ষা দেওয়া রাশিয়ার দায়িত্ব। ফলে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক বয়কটের ঘটনাকে এভাবে প্রতিরোধ করেন পুতিন। অলিম্পিকের পরে পরেই ইউক্রেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সৈন্যবাহিনী পাঠান পুতিন।

এই ইউক্রেন আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, পরে তা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৪ সালেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে সিরিয়া ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ কমাতে এবং জঙ্গি সংগঠন ‘আইসিস’কে ধ্বংস করতে মিসাইল নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন পুতিন। ২০১৮ সালে চতুর্থবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনিই রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের পদে আসীন থাকবেন।