মহাভারতে কে ছিলেন একলব্য

মহাভারতে কে ছিলেন  একলব্য

মহাভারতের আদিপর্বে ১৩২তম অধ্যায়ে নিষাদ রাজপুত্র একলব্যের নাম পাওয়া যায়। পান্ডব ও কৌরব রাজপুত্রেরা একটু বড় হওয়ার পর তাঁদের ধনুর্বিদ্যা শিক্ষার ভার দেওয়া হয় মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র মহাবীর দ্রোণাচার্যকে। দ্রোণ সকল রাজপুত্রকে নিয়ে নিজের আশ্রমে চলে যান এবং শিক্ষা শুরু করেন। খুব তাড়াতাড়িই ধনুর্বিদ্যা ও যুদ্ধকৌশলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেব দ্রোণের নাম ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র ভারতে।

এই কথা জানার পর অন্য অন্য অনেক রাজ্যের রাজপুত্রেরাও দ্রোণের কাছে শিক্ষা নিতে আসতে লাগলেন। একদিন সকালে দ্রোণ দেখলেন একটি ছেলে কাঁধে ধনুক ও পিঠে তূণ নিয়ে তাঁর কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অচেনা ছেলেটিকে দেখে হাসিমুখে দ্রোণ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে বাছা তুমি? এখানে কেন এসেছ?”

ছেলেটি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দ্রোণকে প্রণাম করে বলল, “গুরুদেব, আমি মগধ রাজ্যের নিষাদরাজ হিরণ্যধনু ও রাণী বিশাখার সন্তান একলব্য। আপনার কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে এসেছি।”একথা শুনে দ্রোণের হাসিমুখ নিমেষের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি রেগে গিয়ে একলব্যকে বললেন, “তুমি ম্লেচ্ছ হয়ে আমার কাছে শিক্ষা নিতে এসেছ কোন সাহসে? জাননা আমি হস্তিনাপুরের রাজপুত্রদের গুরু? আমার পক্ষে তোমাকে শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও।” এই কথা বলে দ্রোণ সেখান থেকে চলে গেলেন।

একলব্য হাল ছেড়ে দিলেন না। তিনি গভীর বনে প্রবেশ করে তৈরি করলেন দ্রোণাচার্যের এক মাটির মূর্তি। সেই মূর্তিকেই নিজের গুরু বলে মেনে নিয়ে নিজে নিজেই ধনুক ও তীর নিয়ে অস্ত্রচালনা অভ্যাস করতে শুরু করলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পর একদিন সকল রাজপুত্রেরা শিক্ষার অবসরে গভীর বনে শিকার করতে বেরলেন। এক রাজপুত্রের সঙ্গে ছিল একটি কুকুর।

শিকারে বেরোনোর আনন্দে সে চিৎকার করতে করতে রাজপুত্রদের আগে আগে যেতে লাগলে। এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ কুকুরটি বনের ভেতর ধনুর্বিদ্যা অভ্যাসরত একলব্যের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। অচেনা লোক দেখে আরও জোরে সে চিৎকার শুরু করে দিল। কুকুরের চিৎকারে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায় ভীষণ বিরক্ত হলেন একলব্য।

অন্য উপায় না দেখে একসঙ্গে সাতটি তীর এমনভাবে কুকুরটির মুখে মারলেন যে কুকুরটির আর চিৎকার করার ক্ষমতা রইলো না। ল্যাজ গুটিয়ে কুকুরটি ফিরে গেল প্রভুদের কাছে। প্ৰিয় পোষ্যের এমন অবস্থা দেখে বড়ই অবাক হলেন রাজকুমারেরা। সেইসঙ্গে এমন অসাধারণ ধনুর্বিদকে দেখার জন্য যথেষ্ট কৌতূহলীও হয়ে পড়লেন সকলে।

তাই সবাই মিলে বনের আরো গভীরে প্রবেশ করলেন এবং একাকী অভ্যাসরত একলব্যকে দেখতে পেলেন। রাজপুত্রেরা তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে একলব্য নিজের নাম, বাবার নাম বললেন এবং নিজেকে দ্রোণাচার্যের শিষ্য বলে পরিচয় দিলেন।এই কথা শুনে অর্জুনের মনে দারুণ অভিমান হল। কারণ গুরু দ্রোণ কথা দিয়েছিলেন যে অর্জুনই হবেন বিশ্বের সেরা ধনুর্ধর।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই নিষাদকুমারের ক্ষমতা অর্জুনের থেকে অনেক বেশী। অর্জুন তখন দ্রোণের কাছে গিয়ে বললেন, “গুরুদেব, আমি কী অপরাধ করেছি যে আপনি আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একজনকে এত ক্ষমতা দান করলেন?” অর্জুনের কথা শুনে খুব অবাক হয়ে দ্রোণাচার্য বললেন, “কার কথা বলছ তুমি অর্জুন? কাকে আমি তোমার থেকে বেশি ক্ষমতা দিয়েছি?”অর্জুন তখন নিষাদরাজের ছেলে একলব্যের কথা বললেন।

একথা শুনে খুব আশ্চর্য হলেন গুরু দ্রোণ। নিজের দেওয়া কথা রাখতে পারবেন না বলে ভয়ও পেলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন এই নিষাদকুমারকে আটকাবার উপায়। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি অর্জুনকে ও অন্য রাজপুত্রদের নিয়ে সেই বনের দিকে গেলেন। বনে গিয়ে তাঁরা একলব্যকে দেখতে পেলেন। দ্রোণকে দেখতে পেয়েই একলব্য ছুটে এসে তাঁকে প্রণাম করলেন।

দ্রোণ তখন বললেন, “বাছা, তোমার শিক্ষা শেষ হয়েছে। তুমি তো আমাকে গুরু বলে মেনে নিয়েছ। তাহলে আমাকে এখন গুরুদক্ষিণা দাও।” গুরুর কথা শুনে খুব আনন্দ পেলেন একলব্য। হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলুন গুরুদেব, কী দক্ষিণা চাই আপনার? আমি কথা দিচ্ছি, আপনি যা চাইবেন আমি আপনাকে তাই এনে দেব।” দ্রোণ তখন বললেন, “আমি তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি চাই।

এই আমার গুরুদক্ষিণা। তাছাড়া অন্য কোনো দক্ষিণা আমি নেব না।”এমন কথা শুনে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না একলব্য। ছুরি দিয়ে কেটে ফেললেন নিজের হাতের বুড়ো আঙুল। অর্পণ করলেন গুরুর পায়ে। খুব খুশি হলেন গুরু দ্রোণ। রক্তাক্ত হাতে তীর-ধনুক তুলে নিয়ে নীরবে বন ছেড়ে চলে গেলেন একলব্য।অবশ্য একলব্য হার মানেননি।

ক্রমাগত অভ্যাস করে করে তিনি ডান হাতের চারটি আঙুল দিয়েই তীর চালানো শিখে নিয়েছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। একলব্যের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কে মহাভারতে আর কিছু জানা যায় না। তবে হরিবংশ পুরাণ থেকে জানা যায়, এই একলব্য আসলে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বাবা বসুদেবের আর এক ভাই দেবশ্রবার ছেলে। তাঁর জন্মের সময় দৈববাণী হয়েছিল যে, যদু বংশের কোন ব্যক্তির হাতেই এই শিশুর মৃত্যু হবে। একথা জানার পর ভয় পেয়ে দেবশ্রবা তাঁর ছেলেকে নদীতে ভাসিয়ে দেন।

ভাসতে ভাসতে সেই শিশু মগধরাজ্যে এসে পৌঁছয় এবং নিষাদরাজ হিরণ্যধনু শিশুটিকে লালন-পালন করেন। দ্রোণাচার্যের আশ্রম থেকে ফিরে আসার পর মগধরাজ জরাসন্ধ একলব্যকে নিজের সেনাবাহিনীতে সেনাপতিরূপে নিযুক্ত করেন। জামাই কংসকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জরাসন্ধ যখন শ্রীকৃষ্ণের রাজ্য মথুরা আক্রমণ করেন, তখন একলব্য বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মথুরার সেনাবাহিনীর এক বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেন।

মথুরার পরাজয় নিশ্চিত দেখে যুদ্ধে নামেন শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর হাতেই একলব্যের মৃত্যু হয়। এইভাবেই দৈববাণী সত্য হয় এবং একলব্যের জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত গুড়গাঁওয়ের খণ্ডসা গ্রামে একলব্যের একটি মন্দির আছে। সারা ভারতে এই একটি মন্দিরেই দেবতা রূপে পূজিত হন নিষাদকুমার। মনে করা হয়, এই স্থানেই একলব্য নিজের বুড়ো আঙুল কেটে দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন। বলা হয়, সেই কাটা আঙুলটি এখানকার মাটিতে পোঁতা আছে এবং এক অবহেলিত প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ এই মন্দির তার উপরেই নির্মিত হয়েছে। 

[ আরও পড়ুন জামাই ষষ্ঠী ]