উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (অথবা উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী (Womesh Chandra Bonnerjee)একজন ভারতীয় ব্যারিস্টার যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সহ প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সভাপতি ছিলেন। ১৮৪৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে উমেশচন্দ্রের জন্ম হয়৷ তিনি ছিলেন রাঢ়ী শ্রেণীর কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান৷ এই ব্রাহ্মণ পরিবারের আদি বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বাগাণ্ডায়৷ উমেশচন্দ্রের বাবা গিরীশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হাইকোর্টের অ্যাটর্নি ছিলেন।

উমেশচন্দ্রের মায়ের নাম সরস্বতী দেবী৷ ঠাকুরদা পীতাম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই বাগাণ্ডা থেকে কলকাতার খিদিরপুরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের উঠে আসা৷ উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মায়ের বংশের দিক থেকে হুগলী জেলার ত্রিবেণীর বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন-এর বংশধর। উমেশচন্দ্রের প্রাথমিক পড়াশোনা ওরিয়েন্টাল সেমিনারী স্কুলে শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে হিন্দু স্কুলে সম্পন্ন হয়৷ পড়াশোনায় অমনোযোগীতার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে দশম শ্রেনীর পরীক্ষার আগেই এক বিখ্যাত ইংরেজ অ্যাটর্নি অফিসে কাজে ঢুকিয়ে দেন৷ তাঁর বাবার পরম বন্ধু গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে উমেশচন্দ্র ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন৷ 

উমেশচন্দ্রের কর্মজীবন শুরু হয় ১৮৬২ সালে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নিদের সংস্থা ডাব্লু পি গিল্যান্ডার্সে একজন করণিক হিসাবে। এই পদে থাকাকালীন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আইন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যা তাঁকে পরবর্তীকালে তাঁর আইনি পেশায় ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। তাঁর বিচার বুদ্ধি ও তর্ক শক্তি অসাধারণ ছিল। তিনি চারবার স্ট্যান্ডিং কাউন্সেলের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন৷ ১৮৬৪ সালে বম্বের আর.জে জিজিবাইয়ের পক্ষ থেকে বৃত্তি লাভের মাধ্যমে তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়।

ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি মিডল টেম্পলে পড়াশোনা করে ১৮৬৭ সালের জুন মাসে বার কাউন্সিলে ডাক পান। ১৮৬৮ সালে উমেশচন্দ্র কলকাতায় ফিরে এসে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ স্যার চার্লস পলের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক বছরের মধ্যে হাইকোর্টের ব্যারিস্টারদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠেন। ১৮৭১ সালে তিনি ‘হিন্দু উইলস অ্যাক্ট ১৮৭০'(Hindu Wills Act of 1870) সম্পাদনা করেন৷ উমেশচন্দ্র  স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল হিসেবে প্রথম ভারতীয় ছিলেন এবং সেই ক্ষমতাবলে তিনি যথাক্রমে ১৮৮২, ১৮৮৩, ১৮৮৪, ১৮৮৬-৮৭ ও সালে তিনি চারবার এই দায়িত্ব সামলেছিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে  আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হলে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির হয়ে লড়েছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল সেই সাথে ছিল স্বদেশ সেবায় প্রবল উৎসাহ৷ তাঁর অমায়িক ব্যবহারের জন্য জনসাধারণ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেও ব্যক্তিজীবনে উগ্র সাহেবিয়ানার জন্য ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় তাঁর তীব্র সমালোচনাও হয়েছিল৷   উমেশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন এবং সেখানকার আইন পরিষদের সভাপতিও ছিলেন। 

১৯০১ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্ট থেকে অবসর গ্রহণ করেন।তাঁর কর্মজীবনের একটি বড় পর্যায় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাহিত হয়েছে৷ ১৮৬৫ সালে দাদাভাই নওরোজির সহায়তার লন্ডনে তিনি ভারতীয়দের জন্যে ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করেন। পরে ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপনেও তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন।  ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বম্বেতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন যেখানে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র বাহাত্তর।

তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ও অষ্টম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৮৯২ সালে এলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের অষ্টম অধিবেশনে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ভারতের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে এই অবস্থানকে অস্বীকার করেছিলেন। ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন। ১৮৯৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিবারেল দলের প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করেছিলেন। 

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উদারনৈতিক এবং স্ত্রীশিক্ষার উৎসাহী সমর্থক। সেজন্যেই তাঁর স্ত্রী হেমাঙ্গিনীকে আধুনিক শিক্ষা শিক্ষিত করে তাঁকে আধুনিকা করে তোলেন। তাঁর স্ত্রী খ্রীষ্টানধর্মালম্বী হলেও তিনি স্ব-ধর্ম ত্যাগ করেননি৷ ১৮৭৪ সালের প্রথম দিকে দুই সন্তান সহ হেমাঙ্গিনীকে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ইংল্যান্ড পাঠান ।

১৮৮৮ সালে উমেশচন্দ্র লন্ডনের দক্ষিণ শহরতলীতে একটি বাড়ি কেনার পর হেমাঙ্গিনী তাঁর সন্তানদের নিয়ে স্থায়ীভাবে লন্ডনে বাস করতে থাকেন। এই বাড়িটি কার্যত প্রবাসী ভারতীয়দের রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। উমেশচন্দ্রের সন্তানেরা অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর উমেশচন্দ্র ১৯০২ থেকে স্থায়ীভাবে লন্ডনের ক্রয়ডনে বসবাস শুরু করেন। ১৯০৬ সালের ২১ জুলাই  লন্ডনের ক্রয়ডনে থাকাকালীন উমেশচন্দ্রের মৃত্যু হয়। তাঁর চিতাভষ্ম লন্ডনের বাড়ির এক প্রান্তে রক্ষিত আছে।