সিনেমায় ডিরেক্টরস কাট বলতে কি বোঝায়

সিনেমা জগতে ডিরেক্টর’স কাট (Director’s Cut) একটি নতুন শব্দ বন্ধ। কিন্তু কি এই ডিরেক্টর’স কাট সে সম্পর্কে জানতে গেলে আগে একটি সিনেমা সম্পাদনা হয় কীভাবে তা আগে জানতে হবে। যেকোনো ছবি শুটিংয়ের পরে থেকে সেটি হল-এ (Hall) বা টেলিভিশনে বানিজ্যিকভাবে দেখানো শুরু করার আগে অবধি চলে ছবি সম্পাদনার একটা দীর্ঘ পর্ব যাকে চালু ইংরেজি ভাষায় পোস্ট প্রোডাকশন পর্ব বলা হয়ে থাকে।
ছবিটি তৈরির সাথে নানান স্তরে যুক্ত মানুষদের মতামত নিয়ে ছবিটিকে দর্শকের মনোগ্রাহী করে তোলার চেষ্টা চলে এই সময়ে। শুধুমাত্র কাহিনীচিত্রই নয়, বিজ্ঞাপন চিত্র, তথ্যচিত্র, অ্যানিমেশন ছবি, মিউজিক ভিডিও, টেলিভিশন সিরিজ এমন কি হাল আমলের ওয়েব সিরিজের মতো সব ধরনের অডিও ভিশুয়াল প্রস্তুতিই এই ধারা মেনে চলে।
ছবি তৈরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম মেনে চলার কারণটি শুধুই অর্থনৈতিক নয়, এর সাথে অনেক মানুষ সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার ফলে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার শুধুমাত্র পরিচালক বা প্রযোজকের থাকেনা। শুটিংয়ের পরে এই পর্বে যাবতীয় ফুটেজ বা তোলা ছবি একত্রিত করে ছবির কাহিনী ও স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী একটি সময়রেখা বা টাইমলাইন তৈরি করা হয়। তারপর, নির্দেশকের পরামর্শ মতো ছবির সম্পাদক বা এডিটর আরও কাটছাঁট করে ছবিটিকে একটি বিশেষ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এই ক্ষেত্রে নির্দেশকের পরামর্শ ছাড়াও সম্পাদকের নিজস্ব ভাবধারার ছায়া পরে ছবিটির উপর। এর ফলে যে সংস্করণটি তৈরি হয়, তাকে ‘এডিটর’স কাট’ বলা হয়। এই সংস্করণের উপর নিজের চিন্তাধারার মশলা মিশিয়ে তাঁর নিজের মনোমত একটি সংস্করণ তৈরি করেন খোদ নির্দেশক, যাকে কলাকুশলীরা সচরাচর ডিরেক্টর’স কাট থাকেন। সব নির্দেশকের কিন্তু এই ডিরেক্টর’স কাট তৈরি করার অধিকার থাকেনা। আবার দর্শকেরা যে এই ডিরেক্টর’স কাট সংস্করণটিই হল-এ গিয়ে দেখতে পান, তা নয়।
এই ডিরেক্টর’স কাট সংস্করণটি যাচাই করেন মূলত ছবির প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর এবং রিলিজ পর্বের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু লোকজন, যারা মূলত ছবিতে অর্থলগ্নি করেছেন। ছবিটির গতি, তার ক্লাইম্যাক্স, সঙ্গীত, ছবির দৈর্ঘ্য এই সব বিষয়েই অনেক ক্ষেত্রে শেষ কথা বলেন তাঁরাই। আর কি করলে ছবিটি দর্শকদের আনুকুল্য পেতে পারে, সে বিষয়ে তাঁরা মতামত দিয়ে থাকেন এবং অনেক ভাবনাচিন্তার পর্ব অতিক্রম করে, সেই মতামত মেনে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন করে ছবিটি বানিজ্যিকভাবে মুক্তিলাভ করে।
তাহলে, এত লোক থাকতে ডিরেক্টর’স কাট নিয়ে এতো মাথাব্যথা কেন? এর মূল কারণ হল, ছবি তৈরির সাথে এতো মানুষ যুক্ত থাকলেও এখনও চলচ্চিত্রশিল্পকে নির্দেশকের মাধ্যম বা ডিরেক্টর’স মিডিয়াম বলেই মান্যতা দিয়ে আসা হয়। যদিও, বানিজ্যিকভাবে সফল ছবি তৈরির রসায়ন এত বছর পরেও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে। ছবি সফল হলে যেমন ছবির সাথে যুক্ত সকলেই সাফল্যের স্বাদ পান, ছবি অসফল হলে অনেকগুলো মানুষের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমও ব্যর্থ হয়।
এই ডিরেক্টর’স কাটের প্রথম নিদর্শন দেখা যায় প্রায় এক শতাব্দী আগে। ১৯২৫ সালে মুক্তি লাভ করা চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গোল্ড রাশ’ ছবিটি সুপারহিট হয় এবং বহু প্রজন্ম ধরে দর্শকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম নির্মাতা, নির্দেশক চার্লি চ্যাপলিন ছবিটি নিয়ে নিজের মনের দ্বন্দ মেটাতে আবার ছবিটি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।
ছবিটি আরেক প্রস্থ সম্পাদনার পর, নতুন সুর, নতুন ভাষ্যপাঠ এবং বেশ কিছু অতিরিক্ত দৃশ্য নিয়ে আবার মুক্তিলাভ করে ১৯৪২ সালে। ছবিটিকে প্রযুক্তির দিক দিয়েও আরও উন্নত করা হয় যাতে ছবির দৈর্ঘ্য কমে যায় প্রায় ২৩ মিনিট। দুটি সংস্করণই বর্তমানে পাওয়া গেলেও, ১৯৪২ সালের সংস্করণটিকেই দ্য গোল্ড রাশের সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে ধরা হয়। এই নতুন গোল্ড রাশ শুধু যে বানিজ্যিক সাফল্যই পেল তা নয়, নির্দেশকের গুরুত্বকে আরও প্রতিষ্ঠিত করল এবং সেই সাথে জন্ম দিল ডিরেক্টর’স কাট নামের এক নতুন ধারার।
এমনই কিছু নিদর্শন আবার চোখে পড়তে শুরু করল সত্তরের দশকে। ১৯৭১ সালে ‘টি এইচ এক্স ১১৩৮’ নামে তাঁর ছাত্রাবস্থায় তৈরি একটি ছবির পুনর্নির্মাণ করেন জর্জ লুকাস। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ছবির দৈর্ঘ্য অনেকটা কমানোর পরেও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয় ছবিটি। মুখ থুবড়ে পরে প্রযোজনা সংস্থা। পরবর্তীকালে তাঁর তৈরি ‘স্টার ওয়ার্স’ সিরিজের ছবিগুলি যুগান্তকারী সাফল্য এনে দিলেও, প্রথম ছবির ব্যর্থতার কথা ভুলতে পারেননি জর্জ লুকাস।
অ্যানিমেশনের প্রযুক্তিতে প্রভূত উন্নতির পরে প্রথম সংস্করনে বাদ যাওয়া অনেক সীন আবার যুক্ত করে, ছবিতে নতুন অ্যানিমেশন যুক্ত করে, গোটা ছবির খোলনলচে বদলে ‘টি এইচ এক্স ১১৩৮’ এর দ্য জর্জ লুকাস ডিরেক্টর’স কাট আবার মুক্তি পায় ২০০৪ সালে। ১৯৭৭ সালে জর্জ লুকাসের বন্ধু স্টিফেন স্পিলবার্গ তৈরি করেন ‘ক্লোস এনকাউন্টারস অফ দ্য থার্ড কাইন্ড’ নামে একটি চলচ্চিত্র। ডিরেক্টর’স কাট তৈরি করার সুযোগ থাকলেও ছবিটির রিলিজের তারিখ এগিয়ে আসছিল বলে তাড়াহুড়ো করে সম্পাদনা পর্ব শেষ করতে হয় তাঁকে।
ছবিটি প্রভূত সাফল্য পেলেও নির্মাতা হিসেবে এই গাফিলতিগুলি মেনে নিতে পারেননি স্পিলবার্গ। ছবিটি সফল হওয়ায় তিনি সুযোগ পেলেন সেটির উপর আবার কাজ করার।১৯৮০ সালে আবার মুক্তিলাভের সময়েও স্টুডিয়োর জোরাজুরিতে ছবির শেষ পর্বটি মনোমত হয়নি তাঁর। ১৯৯৮ সালে অবশেষে স্পিলবার্গ এই ছবির একটি অফিশিয়াল ডিরেক্টর’স কাট প্রকাশ করেন, যেখানে স্টুডিয়ো মনোনীত শেষাংশটি বাদ যায়।
চ্যাপলিন, লুকাস বা স্পিলবার্গের হাতে শুরু হলেও এই ডিরেক্টর’স কাট সংস্করণের একটি বানিজ্যিক দিক প্রযোজনা সংস্থাগুলির চোখে পরে আশির দশকে। সেই সময় ব্যক্তিগত ভি সি আর-এ স্থানীয় ভিডিও পার্লার থেকে এনে এইসব ছবির হোম ভিডিও সংস্করণ দেখার প্রবণতা শুরু হয়। স্টুডিয়োগুলিও এই সুযোগে পুরনো ছবির ডিরেক্টর’স কাট সংস্করণ রিলিজ করা শুরু করে।
মাইকেল কিমিনোর ছবি ‘দ্য হেভেন্স গেট’ বানিজ্যিক ছবি হিসেবে আগেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত টি ভি চ্যানেল, চ্যানেল জেড এই ছবির একটি ডিরেক্টর’স কাট দেখানোর ব্যবস্থা করে যেটি দৈর্ঘ্যে মূল ছবিটির থেকে প্রায় ৫০ মিনিট কম। তথাকথিত বানিজ্যিকভাবে অসফল এই ছবিটিকে নতুন চেহারায় দেখে দর্শক মহলে বেশ সাড়া পরে যায়। ‘হেভেন’স গেট’ হয়ে ওঠে এই চ্যানেলে প্রচারিত সবথেকে জনপ্রিয় ছবি।
এঁর আগেই ‘দ্য গোল্ড রাশে’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্তরের দশকে তাঁর সব কটি ছবিই আবার সম্পাদনা করে বানিজ্যিকভাবে রিলিজ করেছেন স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিন। ডিরেক্টর’স কাটের আরও ব্যপক ব্যবহার দেখা যায় নব্বইয়ের দশকে, যখন নির্দেশক জেমস ক্যামেরনের তৈরি ‘দ্য আবিস’, ‘এলিয়েন্স’, ‘টার্মিনেটর ২: জাজমেন্ট ডে’ র মতো বানিজ্যিকভাবে সফল ছবিগুলির ডিরেক্টর’স কাট পরপর প্রকাশিত হতে থাকে হোম ভিডিও’র দৌলতে।
পার্থক্য একটাই ডিরেক্টর’স কাট নামের বদলে জেমস ক্যামেরন এই সংস্করণগুলির নাম দিলেন স্পেশাল এডিশন। কিন্তু ব্যবহারিক দিক দিয়ে এই দুই সংস্করণের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হল ‘রিডলে স্কটের নির্দেশনায় তৈরি ‘ব্লেড রানার’ ছবিটি। ১৯৯০-৯১ সাল নাগাদ এই ছবির অন্য একটি সংস্করণ দর্শকদের আনুকুল্য পাওয়ার পর ১৯৯২ সালে ব্লেড রানারের ডিরেক্টর’স কাট প্রকাশ করেন ওয়ার্নার ব্রাদার্স।
এর আরও বেশ কিছু বছর বাদে ডিভিডি এবং ব্লু-রে(Blu-Ra) ডিস্ক প্রযুক্তি বাজারে আসার পর আবার এই ছবির আরেকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় যার নাম দেওয়া ‘ব্লেড রানার:দ্য ফাইনাল কাট’। স্পেশাল এডিশন, ফাইনাল কাটের পর এই ধারারই হাত ধরে ক্রমান্বয়ে আসতে থাকে বিভিন্ন ছবির এক্সটেন্ডেড ডিরেক্টর’স কাট, ওয়ার্কপ্রিন্ট এডিশন, এমনকি আনকাট বা আনরেটেড সংস্করণ যা হলে দেখানোর সময় কোনও কারণবশত বাদ দেওয়া হয়েছিল।
১৯৮৪ সালের ‘ওয়ানস আপন এ টাইম ইন আমেরিকা’,’আ্যপোক্যালিপ্স নাও’,’জাস্টিস লিগ’, ‘কিংডম অফ হেভেন’, ‘সুপারম্যান-২’, ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’ এর মতন ছবি বারবার নির্মাতারা তৈরি করেছেন, আবার তা নষ্টও করে ফেলেছেন কখনও স্টুডিয়োর সাথে দ্বৈরথের ফলে, কখনও বিদেশী দর্শকের কথা মাথায় রেখে আবার কখনও নিছকই শৈল্পিক কারণে। প্রযোজনা সংস্থা এর ফলে লাভবান হয়েছেন কি হননি, তার চেয়ে জরুরী হল, ঋদ্ধ হয়েছে সাধারণ দর্শক। একই ছবির থেকে রামধনুর মতো রং ছড়াতে দেখে তাঁদের কোনও ক্ষতি হয়নি।