গোয়া সংযুক্তিকরণ এর অজানা ইতিহাস

গোয়া সংযুক্তিকরণ এর অজানা ইতিহাস

ভারতের স্বাধীনতার সময়ে প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছিল দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণ। লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রণীত ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন’ নামে একটি চুক্তির ভিত্তিতে বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার কিছু রাজ্য প্রথমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি, বরং নিজেরাই একটা পৃথক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়েছিল যা তৎকালীন ভারত সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

ফলে এই সব দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরণ নিয়ে বিবাদ চরমে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতে এই দেশীয় রাজ্যগুলির পাশাপাশি বেশ কিছু উপনিবেশিত রাজ্যও ছিল। ফরাসিদের উপনিবেশ, পর্তুগিজদের উপনিবেশগুলি ভারতের মধ্যেই ছিল তখন। স্বাধীনতার সময়ে ব্রিটিশরা এই দেশ থেকে সমস্ত অধিকার প্রত্যাহার করে চলে যেতে চাইলেও, ফরাসিরা বা পর্তুগিজরা চলে যেতে চায়নি, তাদের উপনিবেশগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতেও চায়নি।

এই নিয়েই সমস্যা দানা বাঁধে আর ঠিক এই কাহিনিই লুকিয়ে আছে গোয়া সংযুক্তিকরণ এর (Annexation of Goa) পিছনে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরে গোয়া ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে ষোড়শ শতাব্দীতে গোয়ায় প্রথম পর্তুগিজদের শাসন ও আধিপত্য শুরু হয়। তার আগে সুলতানি রাজারা এই গোয়া শাসন করতেন।

আলফানসো ডি আলবুকার্ক নামে জনৈক পর্তুগিজ সুলতানি রাজাদের পরাজিত করে বারংবার যুদ্ধে অবশেষে আধিপত্য লাভ করেছিলেন গোয়ার। যদিও পরে শিবাজির অনুগত মারাঠারা এই গোয়ায় আক্রমণ চালালে পর্তুগিজরা মারাঠাদের সঙ্গে এক চুক্তির ভিত্তিতে কিছু অঞ্চল মারাঠাদের ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু মূল সমস্যা দেখা দেয় ভারতের স্বাধীনতার সময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে যখন দুটি পৃথক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছে ব্রিটিশদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে, তখনও গোয়ায় পর্তুগিজদের শাসন ও আধিপত্য বহাল ছিল।

১৫১০ সাল নাগাদ ভারতের বহু অংশেই পর্তুগিজদের উপনিবেশ গড়ে উঠলেও উনবিংশ শতাব্দীতে এসে শুধুমাত্র গোয়া, দমন, দিউ, দাদরা, নগর হাভেলি এবং আঞ্জেডিভা দ্বীপ তখনও পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। ব্রিটিশরা ভারতের উপর সমস্ত অধিকার ত্যাগ করে চলে গেলেও পর্তুগিজরা তাদের উপনিবেশ ছাড়তে চায়নি। ১৯৫০ সাল থেকেই ভারত সরকার গোয়ার স্থাপিত পর্তুগালের সালাজার শাসকদের কাছে গোয়া সহ অন্যান্য উপনিবেশের সংযুক্তিকরণের অনুরোধ জানালেও তারা প্রতিবারই সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিচ্ছিলেন।

সেই সময় মহারাষ্ট্রওয়ারি গোমন্তক পার্টি একটি দাবি চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে যে গোয়া আসলে মহারাষ্ট্রেরই একটি অংশ এবং এখানকার কোঙ্কনি ভাষাও মারাঠী ভাষার সংলগ্ন একটি উপভাষা, তাই গোয়াকে মহারাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ১৯৪৬ সালের ১৮ জুন তারিখে গোয়ায় রাম মনোহর লোহিয়ার পরিচালিত গান্ধীপন্থী এই আন্দোলন পর্তুগিজ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আন্দোলনকারীদের উৎখাত করে দেয়। পর্তুগিজদের অধিকৃত কোনো স্থানেই কোনো জনসমাবেশ করা যাবে না বলে জানায় পর্তুগাল সরকার।

এই ঘটনায় রাম মনোহর লোহিয়া, লক্ষ্মীকান্ত ভেম্বেরে এবং পুরুষোত্তম কাকোড়কার গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে ভারত গোয়ার অধিকার দাবি করে। ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে গোয়ার জাতীয়তাবাদীরা দাদরা ও নগর হাভেলি দখল করে সেখানে ভারতীয় প্রশাসন স্থাপন করে ফেলে। আবার ১৯৫৫ সালে ভারতীয় সত্যাগ্রহীরা গোয়া অঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে থাকে। প্রাথমিকভাবে তাদের আটকানো গেলেও বিপুল সংখ্যক মানুষ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে পর্তুগিজ সরকার বাধ্য হয়ে গুলি চালায় সত্যাগ্রহীদের উপর।

বহু মানুষ আহও ও নিহত হয়। এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত সরকার এবং তার ফলে গোয়ার অধিবাসীদের দুর্দশা চরমে ওঠে। সেই সময় ভারতের বাইরে থেকে পণ্য আসছিল গোয়ায়। নেদারল্যাণ্ড থেকে আলু, পর্তুগাল থেকে মদ্য ও পানীয়, পাকিস্তান থেকে চাল ও সবজি, শ্রীলঙ্কা থেকে চা, বেলজিয়াম থেকে ইস্পাত এবং জাপান থেকে সিমেন্ট ইত্যাদি।

এমনকি ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণা মেনন পর্তুগিজ শাসককে চিঠি পাঠিয়ে সমঝোতা করে নিতে বললেও কোনো কাজ হয়নি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বুঝতে পারেন যে প্রস্তাব দিয়ে অনুরোধ করে পর্তুগালের কাছ থেকে গোয়া অধিকার করা যাবে না। তাই সক্রিয় ও সশস্ত্র পদ্ধতিতে গোয়া দখলের চেষ্টায় তিনি চালু করেন ‘অপারেশন বিজয়’। ১৯৬১ সালে দশ হাজার ভারতীয় সেনা গোয়ার সীমান্তে পৌঁছে সেটি অধিকার করে নেয়। এই সময় একটি ভারতীয় মাছ ধরার নৌকায় পর্তুগিজরা গুলি চালালে ভারতীয় এক জেলের মৃত্যু ঘটে।

শুরু হয় ভারতের সামরিক অভিযান ‘অপারেশন বিজয়’। দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা ধরে একটানা জলে, মাটিতে এমনকি আকাশেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে পর্তুগিজদের যুদ্ধ চলে। অবশেষে ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর গোয়ার তৎকালীন পর্তুগিজ গভর্নর জেনারেল ম্যানুয়েল আন্তোনিও ভাসালো ই সিলভা আত্মসমর্পণ করেন ভারতীয় বাহিনীর কাছে। এর ফলে দীর্ঘ ৪৫০ বছরের পর্তুগিজ শাসনের অবসান ঘটে গোয়ায়। গোয়া স্বাধীন হয়। আজও ১৯ ডিসেম্বর দিনটি গোয়ায় স্বাধীনতা দিবস হিসেবেই পালিত হয়।

ভারতীয় সেনাদের গোয়া দখলের পরে পাঁচ মাস যাবৎ গোয়ায় সামরিক শাসন জারি ছিল। সমস্ত সাদা চামড়ার পর্তুগিজদের জেলে বন্দি করে দ্বীপান্তরে পাঠানো হচ্ছিল। ভারতীয় সামরিক বাহিনী গোয়ার তৎকালীন আমলাদের সরিয়ে মারাঠি শরণার্থীদের জায়গা করে দেয় গোয়ায়। পর্তুগিজের বদলে সাময়িকভাবে মারাঠিই হয়ে ওঠে গোয়ার সরকারি ভাষা।

তবে ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ৩০ মে পর্যন্ত গোয়া, দমন ও দিউ ভারতের মধ্যেই একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে অবস্থিত ছিল। এই সময়ের মধ্যে ১৯৬২ সালে গোয়া, দমন ও দিউর প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন মহারাষ্ট্রওয়াড়ি গোমন্তক পার্টির পক্ষ থেকে দয়ানন্দ বন্দোড়কর। ১৯৮৭ সালের মে মাসে গোয়াকে ভারতের একটি অন্যতম রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং কোঙ্কণি ভাষাকে সেখানকার সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। গোয়ার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন প্রতাপসিং রানে।