হেনরিয়েটা ল্যাক্স এর জীবনী

বিশ্বের প্রথম ‘অমর মানব কোষগুচ্ছ’ (immortalized human cell line) তৈরি হয়েছিল যার ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুচ্ছ থেকে তিনিই বিখ্যাত আফ্রো-আমেরিকান মহিলা হেনরিয়েটা ল্যাক্স (Henrietta Lacks)। বিজ্ঞানী মহলে এর নাম দেওয়া হয় ‘হেলা কোষগুচ্ছ’ (Hela cell line)। এই হেলা কোষগুচ্ছ থেকেই পরে সফলভাবে ক্লোন তৈরি করা সম্ভব হয়। পরবর্তীকালে রেবেকা স্ক্লুট ‘দ্য ইমমর্ট্যাল লাইফ অফ হেনরিয়েটা ল্যাক্স ’ নামে হেনরিয়েটা ল্যাক্সের একটি বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্রদেশের রোয়ানোকে (roanoke) অঞ্চলে হেনরিয়েটা ল্যাক্সের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জন রান্ডাল প্লিসেন্ট ও মায়ের নাম ছিল এলিসা প্লিসেন্ট। জন্মের পর হেনরিয়েটার নাম রাখা হয়েছিল ‘লোরেটা প্লিসেন্ট’। কীভাবে তাঁর নাম লোরেটা থেকে হেনরিয়েটা হয়ে গেল, এ ব্যাপারে তাঁর পরিবারের লোকজনও ছিলেন অনিশ্চিত।
তাঁর ডাকনাম ছিল ‘হেনি’। ১৯২৪ সালে যখন হেনরিয়েটার বয়স ছিল দশ বছর, তখন দশম সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তানদের একা দেখাশোনা করতে না পেরে হেনরিয়েটার বাবা তাঁদের সবাইকে নিয়ে ভার্জিনিয়ার ক্লোভারে চলে আসেন। এখানে এসে হেনরিয়েটার সব ভাই-বোনদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হেনরিয়েটা চলে যান তাঁর দাদু টমাস হেনরি ল্যাক্সের বাড়ি।
সেখানে হেনরিয়েটা থাকতে শুরু করেন এক দোতলা লগ-কেবিনে। এখানে তাঁর সঙ্গে থাকতেন তাঁর নয় বছর বয়সী মাসতুতো ভাই ডেভিড ল্যাক্স। ১৯৩৫ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে হেনরিয়েটা এবং ডেভিডের প্রণয়ের ফলস্বরূপ একটি পুত্রসন্তানের জন্ম নেয়। এরপর ১৯৩৯ সালে হেনরিয়েটার আরো একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তাঁদের কন্যা এলসি ল্যাক্স জন্ম থেকেই মৃগী ও সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ছিল।
তাঁর পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী সে ছিল মূক এবং বধির। এরপরে পরিবারের অনুমতিক্রমে ১৯৪১ সালের ১০ এপ্রিল হেনরিয়েটা ও ডেভিডের বিয়ে হয়। টমাস হেনরি ল্যাক্সের কেবিন থেকে দুই মাইল দূরে একটি কৃষ্ণাঙ্গদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই কাজের জন্য তাঁকে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ক্লোভারে বসবাসকারী তাঁর বেশিরভাগ আত্মীয়দের মতোই, হেনরিয়েটা ল্যাক্সও একটি তামাকের খামারে কাজ করতেন।
তিনি পশুদের খাওয়াতেন, বাগান দেখাশোনা করতেন ও ক্ষেতে কাজ করতেন। কাজ করতে গিয়ে তাঁর বেশি পড়াশোনা করা হয়নি। ডেভিড ও হেনরিয়েটা উভয়ই বিয়ের পর খুড়তুতো ভাই ফ্রেড গ্যারেটের পরামর্শে ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে আসেন বাল্টিমোর কাউন্টির মেরিল্যান্ডের ডান্ডালক অঞ্চলের কাছে টার্নার স্টেশনে। এখানে এসে ডেভিড মেরিল্যান্ডের স্প্যারো’স পয়েন্টের ‘বেথলেহেম স্টিল’ নামে একটি কোম্পানিতে কাজ নেন। মেরিল্যান্ডে থাকার সময় হেনরিয়েটা ও ডেভিডের আরো তিনটি সন্তান জন্ম নেয়।
তাদের নাম ছিল যথাক্রমে ডেভিড ‘সোনি’ ল্যাক্স, ডেবোরা ল্যাক্স ও জোসেফ ল্যাক্স। জোসেফের জন্মের চার মাস পরে হেনরিয়েটার জরায়ুমুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এই সময়ের কিছুদিন আগে থেকেই হেনরিয়েটা নিজের পেটের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ডের উপস্থিতি অনুভব করছিলেন। তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের একথা জানালে তাঁরা ভেবে নেন যে হেনরিয়েটা গর্ভবতী। কিন্তু জোসেফের জন্মের পরে হেনরিয়েটার অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ শুরু হয়। প্রথমে তাঁর ‘সিফিলিস’ রোগ হয়েছে বলে ধরে নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হলেও সেই পরীক্ষার ফল ‘নেগেটিভ’ আসে।
এরপর তাঁর ডাক্তার তাঁকে অন্য জায়গায় চিকিৎসার জন্য যেতে বলেন। ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি হেনরিয়েটা চিকিৎসার জন্য ‘জনস হপকিন্স’-এ যান যেটি ছিল সেই এলাকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একমাত্র হাসপাতাল। সেখানে যাওয়ার পর ডক্টর হাওয়ার্ড. ডব্লিউ. জোন্স হেনরিয়েটার জরায়ুমুখ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মাংসপিণ্ডটির বায়োপসি পরীক্ষা করান আর তার ফলেই হেনরিয়েটার জরায়ুমুখে সংক্রামক ‘এপিডারময়েড কারসিনোমা’ (epidermoid carcinoma) ধরা পড়ে।
এরপর হেনরিয়েটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হয় এবং তাঁর শরীরে রেডিয়াম টিউব ঢুকিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। কিছুদিন পর এক্স-রে চিকিৎসার জন্য আবার ফিরে আসার উপদেশ দিয়ে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসা চলার সময় তাঁর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে হেনরিয়েটার শরীর থেকে দুটি আলাদা কোষগুচ্ছ বিজ্ঞানের পরীক্ষার নমুনা হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল সুস্থ ও স্বাভাবিক অংশের কোষগুচ্ছ এবং অন্যটি ছিল তাঁর জরায়ুমুখে হওয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত অংশের কোষগুচ্ছ।
এই নমুনাগুলি পাঠানো হয় বিজ্ঞানী জর্জ অটো গে’র (George Otto Gey) কাছে যিনি জনস হপকিন্স হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন এবং ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। হেনরিয়েটার ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলি নিয়ে গবেষণা করার সময় জর্জ অটো গে দেখলেন যে এই কোষগুলি কিছুটা অস্বাভাবিক, কারণ তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক কোষগুলির তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করছে এবং এই কোষগুলিকে পরবর্তীকালে আরো গভীরভাবে পরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে।
এই ঘটনার আগে পর্যন্ত পরীক্ষাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা করার জন্য নমুনা হিসেবে যে কোষগুলিকে সংগ্রহ করা হত, সেগুলির কোনোটিই খুব বেশিদিন বেঁচে থাকত না। নানারকম জটিল পরীক্ষাগুলিকে সম্পূর্ণ করার জন্য তা কখনোই যথেষ্ট সময় ছিল না। হেনরিয়েটার ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলিতেই সর্বপ্রথম দেখা যায় যে, তারা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই বেশ কয়েকবার বিভাজিত হতে পারে।
এই কারণেই এই কোষগুলিকে ‘অমর’ (immortal) বলে অভিহিত করা হয়। হেনরিয়েটার মৃত্যুর পর যখন তাঁর দেহ জনস হপকিন্স-এর ময়নাতদন্ত বিভাগে সংরক্ষিত ছিল, তখন জর্জ অটো গে হেনরিয়েটার শরীর থেকে আরো নমুনা এনে দেওয়ার জন্য তাঁর ল্যাবরেটরির সহকর্মী মেরি কুবিসেককে বাধ্য করেছিলেন। কুবিসেকের এনে দেওয়া কোষগুলিকে সংরক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত কৌশলটির নাম ছিল ‘রোলার-টিউব কৌশল’ (roller-tube technique)। এই নমুনা থেকে গবেষক গে একটি কোষকে আলাদা করে নিয়েছিলেন এবং সেই কোষটির বারবার বিভাজন ঘটিয়ে একটি কোষগুচ্ছ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এর অর্থ হল, এই একটি কোষ এবং তা থেকে সৃষ্ট অপত্য কোষগুলির মাধ্যমেই অনেকগুলি আলাদা আলাদা পরীক্ষা একসঙ্গে চালানো যেতে পারে। বিজ্ঞানী গে এই কোষগুলির নাম দেন ‘হেলা কোষগুচ্ছ’ (HeLa cell line)। কারণ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য তাঁর সংগ্রহ করা নমুনাগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য গে-র ব্যবহৃত আদর্শ নিয়মটি ছিল রোগীর নামের ও পদবীর প্রথম দুটি অক্ষর ব্যবহার করা। তাই তিনি ‘Henrietta’ থেকে ‘He’ এবং ‘Lacks’ থেকে ‘La’ এই দুটি অক্ষর নিয়ে উক্ত নমুনাটির নাম রেখেছিলেন ‘HeLa cell line’।
পরীক্ষাগারের নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যে হেলা কোষগুচ্ছের দ্রুত বিভাজিত হওয়ার ক্ষমতা বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটাতে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন রোগের টিকা নিয়ে পরীক্ষা এবং ক্যান্সার নিয়ে গবেষণাতেও এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তখনকার দিনে এই কোষগুলির উচ্চ চাহিদা ছিল এবং অনেক বেশি করে এগুলির পুনরুৎপাদন ঘটানো হত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক বিজ্ঞানীকে এগুলি পাঠানো হয়েছে ক্যান্সার, এইডস, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব, জিন ম্যাপিং এবং এছাড়াও আরো অগণিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করার জন্য।
হেলা কোষগুচ্ছ ছিল সর্বপ্রথম মানব কোষ যা থেকে সফলভাবে ‘ক্লোন’ তৈরি করা গিয়েছিল আর তারপর থেকে টেপ, আঠা, বিভিন্ন প্রসাধনী এবং আরো নানারকম পণ্যদ্রব্যের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। হেলা কোষগুচ্ছ সম্পর্কিত প্রায় ১১ হাজার পেটেন্ট নিবন্ধীকৃত আছে। ১৯৯৬ সালে ‘মোরহাউস স্কুল অফ মেডিসিন’ হেনরিয়েটার নামে মহিলাদের জন্য প্রথম বার্ষিক স্বাস্থ্য সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চিকিৎসক রোল্যান্ড প্যাটিলো।
এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল হেনরিয়েটা ল্যাক্স ও তাঁর কোষগুচ্ছকে সম্মান জানানো এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে আফ্রো-আমেরিকান মানুষদের অবদানকে স্মরণ করা। আটলান্টার মেয়র এই সম্মেলন শুরুর প্রথম দিন অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ১১ অক্টোবরকে ‘হেনরিয়েটা ল্যাক্স ডে’ বলে ঘোষণা করেন। বাল্টিমোরের ‘মর্গান স্টেট ইউনিভার্সিটি’ হেনরিয়েটা ল্যাক্স কে মরণোত্তর ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে।
ওয়াশিংটনের ‘এভারগ্রিন স্কুল ডিস্ট্রিক্ট’ হেনরিয়েটার নামে তাদের নতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম রাখে ‘হেনরিয়েটা ল্যাক্স হেলথ অ্যান্ড বায়োসায়েন্স হাই স্কুল’। ২০১০ সালে রেবেকা স্কলুট (Rebecca Skloot) হেনরিয়েটার জীবনী নিয়ে একটি বই লেখেন যার নাম ছিল ‘দ্য ইমমর্টাল লাইফ অফ হেনরিয়েটা ল্যাক্স ’। ২০১৭ সালে এই বইটির উপর ভিত্তি করে একই নামের একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ওই একই বছরে তাঁর নামে একটি গ্রহাণুর নামকরণ করা হয় ‘৩৪৯৫২৬ ল্যাক্স’। ১৯৫১ সালের ৪ অক্টোবর মাত্র ৩১ বছর বয়সে জরায়ু মুখের ক্যান্সারে এবং রেডিয়াম থেরাপির ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে হেনরিয়েটা ল্যাক্সের মৃত্যু হয়।