দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির দর্শন

দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ  মন্দির দর্শন

হিন্দু ধর্মের প্রাচীন দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন শিব বা মহাদেব। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যকে যদি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের সূচনা ধরা হয়, তবে সেখানেও শিবের উল্লেখ দেখে তাঁর প্রাচীনত্ব টের পাওয়া যায়। হিন্দুপুরাণে মূলত বামনপুরাণে শিবকে লিঙ্গরূপে পূজা করার সূচনাটি চিত্তাকর্ষক একটি ঘটনার মাধ্যমে উল্লিখিত রয়েছে। ভারতবর্ষে এই লিঙ্গপুজার ঐতিহ্য তাই স্বাভাবিকভাবেই বহু পুরাতন।

শিব মহাপুরাণে ৬৪টি জ্যোতির্লিঙ্গ (jyotirlingam) মন্দিরের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে বারোটি সবচেয়ে পবিত্র এবং তাদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়ে থাকে। এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রতিটিই শিবের আলাদা আলাদা প্রকাশ বলে মনে করা হয়। এই বারোটি স্থানের প্রত্যেকটিতেই সাধারণ বিষয় হল শিবলিঙ্গ, আধ্যাত্মিক মতে, যেটি একটি আদিঅন্তহীন আলোক স্তম্ভ, যা আসলে শিবের অসীম প্রকৃতির প্রতীক।

ইতিহাস এবং ধর্মের অদ্ভুত সহাবস্থান লক্ষ করা যায় জ্যোতির্লিঙ্গের অধিষ্ঠানভূমিগুলিতে। জ্যোতির্লিঙ্গ’ শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘জ্যোতি’ অর্থাৎ উজ্জ্বলতা এবং ‘লিঙ্গ’ অর্থে শিবলিঙ্গ যা সর্বশক্তিমান মহাদেবের প্রতীক। অতএব এককথায় জ্যোতির্লিঙ্গের আক্ষরিক অর্থ করলে দাঁড়ায় সর্বশক্তিমানের বা শিবের উজ্জ্বল রূপ বা চিহ্ন। এইখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নিতে হবে।

দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের গুরুত্ব বুঝতে হলে শিবলিঙ্গ এবং জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে তা জানতে হবে । আসলে শিবলিঙ্গ হল পুরুষ ও প্রকৃতির (নারী) সহাবস্থান। পুরুষ ও নারীর সাম্যের ভাবনা এর মধ্যে নিহিত। শাস্ত্রমতে, শিবলিঙ্গ মানব নির্মিত কিন্তু জ্যোতির্লিঙ্গ হল স্বয়ম্ভু শিবের অবতার। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করা হয় যে, যেখানে জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে সেখানেই শিব স্বয়ং আলোক রশ্মি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

এখন জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে পুরাণে বর্ণিত কাহিনিটি শোনা যাক। শিবপুরাণ অনুযায়ী একদা ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে দুজনের তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। সেই বিবাদ সন্তোষজনক পরিণতিতে পৌঁছে থেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা না দিলে তখন মহাদেব একটি আলোকরশ্মির স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে প্রকট হন। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু কেউই সেই আলোকস্তম্ভের আদিঅন্ত খুঁজে পান না। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হন যে, এই দিব্য জ্যোতিই হল শ্রেষ্ঠতম। এভাবেই জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণাটির উদ্ভব।

এই জ্যোতির্লিঙ্গকে সৃষ্টির নির্মাণের প্রতীকস্বরূপ মনে করা হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, অরিদ্রা নক্ষত্রের রাতে শিব স্বয়ং জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হন। ৬৪ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে দ্বাদশ মহাজ্যোতির্লিঙ্গকেই সবচেয়ে পবিত্র মনে করা হয়ে থাকে। ভারতে অবস্থিত যে বারোটি মহা জ্যোতির্লিঙ্গের খ্যাতি জগতজোড়া, সেগুলি হল যথাক্রমে  – গুজরাটের সোমনাথ, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমের মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর মহাকালেশ্বর, মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ার ওঙ্কারেশ্বর, উত্তরাখন্ডের কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের পুণের ভীমাশঙ্কর, উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর বিশ্বনাথ, মহারাষ্ট্রের ত্র্যম্বকেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ, গুজরাটের নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের কাছে ইলোরাতে ঘৃষ্ণেশ্বর।

জনশ্রুতি আছে, যে, বারাণসীই প্রথম স্থান যেখানে জ্যোতির্লিঙ্গ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই কারণেই সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা এই পবিত্র স্থানে মৃত্যু কামনা করে থাকে। এই জ্যোতির্লিঙ্গগুলির সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি জায়গার সঙ্গে কোনো না কোনো পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কাহিনি জড়িত রয়েছে। সেইসব কাহিনি আমাদের ভারতীয় ঐতিহ্যের একটি ধারার স্মারক হয়ে রয়েছে। এখানে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গগুলির প্রতিটি জ্যোতির্লিঙ্গ সম্পর্কেই সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। 

১) সোমনাথ মন্দির (গুজরাট) :  গুজরাটে অবস্থিত সোমনাথ মন্দির দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ। কপিলা, হিরণ এবং সরস্বতী এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই মন্দিরটি প্রথম প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহিঃশত্রু দ্বারা প্রায় ষোলবার এই মন্দিরটি ধ্বংস এবং পুনর্নির্মিত হয়েছে। এটি পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের প্রভাস পাটনে অবস্থিত।

একাদশ শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদ গজনীর দ্বারা প্রথমবার এই মন্দির ধ্বংস করা হয়। অনেক ভাঙা-গড়ার পর বর্তমান মন্দিরটি হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের মারু-গুর্জারা শৈলীতে ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে পুনর্নির্মাণ করা হয়। হওয়ায় সোমনাথ একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ২) মল্লিকার্জুন মন্দির (শ্রীশৈলম, অন্ধ্রপ্রদেশ) : অন্ধ্রপ্রদেশের রায়ালসীমার নান্দিয়াল জেলার শ্রীশৈলম নামক স্থানে এই মন্দিরটি অবস্থিত৷ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন।

প্রাচীন এই মন্দিরের অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্যশৈলী এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই মল্লিকার্জুন মন্দির  এমন একটি পবিত্র আধ্যাত্মিক ভূমি, যেখানে শক্তিপীঠ এবং জ্যোতির্লিঙ্গ সহাবস্থান করছে। এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম ভ্রমরম্বা। আদি শঙ্কর এই স্থানেই তাঁর শিবানন্দ লহরী রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম হরিহরের সময় সর্বাধিক আধুনিকীকরণ হয়েছিল এই মন্দিরের। ৩) মহাকালেশ্বর মন্দির (উজ্জয়ীন, মধ্যপ্রদেশ) : মধ্যপ্রদেশের  উজ্জয়ীন জেলায় শিপ্রা নদীর তীরে এই মহাকালেশ্বরের মন্দির অবস্থিত।

সাতটি মুক্তি স্থল বা সপ্তপুরীর মধ্যে এটি একটি বলে মনে করা হয়। এই মহাকালেশ্বর বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে তাও বেশ চিত্তাকর্ষক। শ্রীকর নামক পাঁচ বছর বয়সী স্থানীয় এক ছেলের প্রার্থনায় ভগবান শিব অভিভূত হয়ে শিপ্রা নদীর তীরে ঘন মহাকাল বনে বাস করতে রাজি হয়ে যান। এভাবেই মহাকালেশ্বরের উদ্ভব। আবার স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে রাজা চন্দ্রসেনের সময় শিব স্বয়ং মহাকালরূপে আবির্ভুত হয়ে শত্রুদের জয় করেছিলেন। আরেকটি মতানুযায়ী রাক্ষসের হাত থেকে রক্ষা পেতে চার ব্রাহ্মণের শিবস্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে মহাকাল তাঁদের সামনে হাজির হয়েছিলেন।

এখানেও শক্তিপীঠ ও জ্যোতির্লিঙ্গের সহাবস্থান রয়েছে। ৪) ওঙ্কারেশ্বর মন্দির (খান্ডোয়া, মধ্যপ্রদেশ) :  মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত খান্ডোয়া জেলার কাছে নর্মদা নদীর তীরবর্তী মান্ধাতা দ্বীপে এই ওঙ্কারেশ্বর মন্দির অবস্থিত।  ওঙ্কারেশ্বর ছাড়াও এখানে মমলেশ্বরের নামে ভগবান শিবের আরেকটি মন্দির আছে এখানে। বলা হয় যে, ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা মান্ধাতা (ভগবান রামের পূর্বপুরুষ) এখানে ভগবান শিবের উপাসনা করেছিলেন যতক্ষণ না ভগবান নিজেকে জ্যোতির্লিঙ্গ হিসাবে প্রকাশ করেছিলেন ততক্ষণ।

আবার কেউ কেউ মনে করে থাকেন, নারদ যখন দেবতাদের বিন্ধ্য পর্বতের তুলনায় সুমেরুকে উচ্চতর বলে দাবি করেন তখন বিন্ধ্য সুমেরুর সমান হওয়ার জন্য শিবের কাছে প্রার্থনা করলে শিব বিন্ধ্যের কাছে হাজির হন। এভাবেই ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের উদ্ভব বলে মনে করেন অনেকে।  ৫) কেদারনাথ মন্দির ( রূদ্রপ্রয়াগ, উত্তরাখন্ড) : উত্তরাখণ্ডের রূদ্রপ্রয়াগ জেলার একটি শহর ও নগর পঞ্চায়েত হল কেদারনাথ যা মূলত কেদারনাথ মন্দিরের জন্যই বিখ্যাত। অষ্টম শতকের দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্য বর্ণিত চার ধামের মধ্যে কেদারনাথ মন্দির হল সবচেয়ে দুর্গম।

এটি মন্দাকিনী নদীর উৎসস্থল চোরাবাড়ি হিমবাহের কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫৮৩ মিটার (১১,৭৫৫ ফুট) উপরে হিমালয়ে অবস্থিত। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় ২০১৩ সালের জুন মাসে শহরটি ব্যাপক ধ্বংসের শিকার হয়। স্কন্দপুরাণেও কেদারনাথের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন পুঁথি অনুসারে অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্যের মৃত্যু কেদারনাথ পর্বতের কাছে কাছেই হয়েছিল। শিব মর্ত্যে যাওয়ার জন্য বুনো শুকরের রূপ ধরে কেদারনাথ উপত্যকার দোলেশ্বরে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

৬) ভীমশঙ্কর মন্দির (পুণে, মহারাষ্ট্র) : এই মন্দিরটি মহারাষ্ট্রের পুণের নিকট খেদ অঞ্চলে অবস্থিত। খেদ তালুককে ডাকিনী দেশ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, তাই এই মন্দিরটি ডাকিনী মন্দির নামেও পরিচিত। শাস্ত্র অনুসারে, কুম্ভকর্ণের পুত্র রাক্ষস ভীম জানতে পারেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার রাম তাঁর পিতাকে হত্যা করেছেন। ভীম বিষ্ণুর উপাসক কামরূপের রাজা ও তাঁর স্ত্রীকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বন্দী করলে তখন ভগবান শিবলিঙ্গ রূপে উদ্ভুত হন। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে শিব ভীমকে পরাজিত করার পরে জ্যোতির্লিঙ্গটি গঠিত হয়েছিল। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান শিবের ঘামের ফোঁটা থেকেই স্থানীয় ভীমা নদীটির জন্ম।

৭) কাশী বিশ্বনাথ মন্দির (বেনারস, উত্তর প্রদেশ) : এই মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের বেনারসে অবস্থিত। মন্দিরটি পবিত্র গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। এখানেও শক্তিপীঠ এবং জ্যোতির্লিঙ্গের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। মনে করা হয়  এটি সমস্ত দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে সবথেকে  পবিত্র মন্দির। ভগবান শিব এখানে বিশ্বনাথ বা বিশ্বেশ্বর নামে পরিচিত যার অর্থ মহাবিশ্বের শাসক।  ৮) ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির (নাসিক, মহারাষ্ট্র) : এই মন্দিরটি মহারাষ্ট্রের নাসিকে গোদাবরী নদীর তীরে ব্রহ্মগিরি পর্বতের কাছে অবস্থিত।

শিবপুরাণ অনুযায়ী গোদাবরী নদী, গৌতম ঋষি এবং অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে শিব ত্র্যম্বকেশ্বরে বসবাস করেছিলেন। মন্দিরটি ব্রহ্মগিরি, নীলগিরি এবং কালাগিরি নামে তিনটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। মন্দিরটিতে তিনটি লিঙ্গ রয়েছে  যা শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মার প্রতিনিধিত্ব করে। লিঙ্গগুলি একটি রত্নখচিত মুকুট দ্বারা আবৃত। মন্দিরটিতে যেমন বেশ কিছু মঠ রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু সাধুদের সমাধিও। ৯) বৈদ্যনাথ মন্দির(দেওঘর, ঝাড়খন্ড ) : এই মন্দিরটি ঝাড়খন্ডের সাঁওতাল পরগনা বিভাগের দেওঘরে অবস্থিত।

এই দেওঘরে শক্তিপীঠও রয়েছে, এখানে দেবীর হৃদয় পড়েছিল। পুরাণ অনুযায়ী রাক্ষস রাজা রাবণ শিবের কাছে সর্বশক্তিমান হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন এমনকি জ্যোতির্লিঙ্গ শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। রাবণ তাঁর দশটি মস্তক উৎসর্গ করেছিলেন শিবকে তপস্যাস্বরূপ। রাবণের এই অসীম ভক্তিতে প্রসন্ন ভগবান শিব পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং আহত রাবণকে সুস্থ করে তোলেন। এখানে শিবের ভূমিকা ঠিক যেন এক ডাক্তার বা বৈদ্যের সমতুল্য। সেকারণে এই জ্যোতির্লিঙ্গ বৈদ্যনাথ নামে পরিচিত।

মানুষ বিশ্বাস করে যে এই জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা করে মোক্ষ লাভ হয়। ১০) নাগেশ্বর মন্দির (দ্বারকা, গুজরাট) : এই মন্দিরটি গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের উপকূলে গোমতি দ্বারকা এবং বাইত দ্বারকা দ্বীপের মধ্যবর্তী পথে অবস্থিত। শিবপুরাণ অনুসারে, সুপ্রিয়া নামে একজন শিব ভক্তকে দারুকা রাক্ষস তার রাজধানী দারুকাভানায় আরও কয়েকজনের সাথে বন্দী করে। সুপ্রিয়া সমস্ত বন্দীদের ‘ওম নমঃ শিবায়ঃ’ উচ্চারণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন যা দারুকাকে ক্ষুব্ধ করে এবং তিনি সুপ্রিয়াকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ভগবান শিব অসুরের সামনে আবির্ভূত হয়ে তাকে নিধন করেন। এইভাবে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের জন্ম হয়।

১১) রামানাথস্বামী মন্দির (রামেশ্বরম,তামিলনাড়ু) :  এই মন্দিরটি তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম দ্বীপে অবস্থিত। এখানে অবস্থিত জ্যোতির্লিঙ্গের উদ্ভবের গল্পটি রামায়ণে বর্ণিত আছে। ভগবান রাম যখন সীতাকে খুঁজছিলেন তখন তাঁকে সাহায্য করেছিল বানর সেনা। সীতাকে খুঁজতে রাম দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমে পৌঁছন এবং সেখানে শিবের কাছে প্রার্থনা করার জন্য একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে পূজা করেন। শিব ও পার্বতী তখন সন্তুষ্ট হয়ে রামের সামনে আবির্ভূত হন। রাম তখন শিবকে সেখানে চিরকালের জন্য অবস্থান করার অনুরোধ জানান।

এভাবেই রামানাথস্বামী মন্দিরে অবস্থিত লিঙ্গটি নির্মিত হয়েছিল। ১২) ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দির (ঔরঙ্গাবাদ, মহারাষ্ট্র) :  এই মন্দিরটি  মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে অবস্থিত। সুদেহা এবং সুধর্ম ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। সুদেহার গর্ভে কোনো সন্তান না হলে সুদেহা সুধর্মকে বলেছিল তার ভাগনী ঘুষনাকে বিবাহ করে পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে। কিন্তু সুধর্ম রাজী হননি। অন্যদিকে ঘুষনা ছিলেন শিবভক্ত, রোজ একশত এক লিঙ্গের পূজা করতেন। লিঙ্গগুলির পূজা শেষ হলে ঘুষনা এক পুত্রের জন্ম দেন। অবশেষে ঘুষনাকে বিবাহ করেন সুধর্ম।

ক্রমে সুদেহার ঈর্ষা বাড়তে থাকে। একসময় সুদেহা ঘুষনার পুত্রকে হত্যা করে পুকুরে ফেলে দেয়, সেই পুকুরেই লিঙ্গগুলিকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন ঘুষনা। এমতাবস্থায় ঘুষনা শিবের কাছে প্রার্থনা করেন। ভক্তি দেখে শিব ঘুষনার পুত্রকে পুনরুত্থিত করেন কিন্তু সুদেহাকে হত্যা করতে চাইলে ঘুষনা শিবের কাছে সুদেহার জীবন ভিক্ষা চেয়ে নেন। এই জ্যোতির্লিঙ্গের নেপথ্যে এই গল্পই প্রচলিত। এই ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরটি তেরো শতকে মুঘল-মারাঠা সংঘর্ষের সময়  ভেঙে যায়। পরে ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাই হোলকরের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি পুনর্নির্মিত হয়েছিল।