মা লক্ষ্মীর কৃপায় সংসারে সুখ আসে, আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়

আজবাংলা বৃহস্পতিবার অর্থাৎ বাঙালির লক্ষ্মীবার ৷ এই দিন বিশেষ করে বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ৷ মা লক্ষ্মীর কৃপায় সংসার যাতে সুখের হয় সেই দিকেই নজর দিয়ে থাকেন সবাই ৷ তাই নানান ধরনের নিষ্ঠা ও আচার আচরণ পালন করা হয়ে থাকে ৷প্রতিটি সংসারের সুখ বা সমৃদ্ধি সমস্ত কিছুর দেবী মা লক্ষ্মী ৷ পুরাণ মতে যে ঘরে লক্ষ্মীর বসবাস সেই ঘরে কখনও অভাব থাকেনা ৷ মা লক্ষ্মীর বসবাসের জন্য বিশেষ করে কোনও সরঞ্জাম লাগেনা ৷ মা লক্ষ্মীর বাসস্থান ঠিক ঘরেই যে ঘরে সুখ ও শান্তি একই সঙ্গে বসবাস করে ৷
গৃহস্থের কল্যাণে মা লক্ষ্মীর এক বড়সড় ভূমিকা রয়েছে ৷ অত্যন্ত শান্তির সঙ্গে তিনি বসবাস করেন ৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষার প্রগতি, সুখী সংসার, সন্তানের লেখাপড়া ও সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে এই কামনাই সমস্ত মায়েদের ৷ কেননা সংসার সুখের হয় রমনির গুণে ৷ লক্ষ্মীবারে মা লক্ষ্মীর পাঁচালির পাঁচালি পাঠ করলে বিশেষ মঙ্গল হয়ে থাকে ৷ মায়ের আগমনে সংসারে সমৃদ্ধি হয় ৷ প্রতি বুধবার রাত দশটার পরে মা লক্ষ্মীর সঙ্কল্প করলে বৃহস্পতিবার বিসেষ সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব হয় ৷
প্রচলিত আছে মা লক্ষ্মী কোনও রকমের আওয়াজ বা অশান্তি পছন্দ করেন না ৷ তাই শান্তিতে ও নিরিবিলিতেই তিনি বসবাস করেন ৷ মা লক্ষ্মীর আগমনের জন্য গৃহস্থকে শান্ত ও স্নিগ্ধ হতে হয় ৷ প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ির মহিলারা যদি জলপূর্ণ ঘটে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করেন সেই সংসারের বিশেষ মঙ্গল হয় ৷ মা লক্ষ্মীর কৃপায় সংসারে সুখের বসবাস হয় ৷
পূজাপ্রণালী
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উত্স সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন।
তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন।
ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন। এবার লক্ষ্মীকে ধ্যান করবেন। লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হল—
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
মন্ত্রটি পাঠ করতে ভাল। নয়তো লক্ষ্মীর রূপটি চোখ বুজে মনে মনে খানিকক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আবাহন করবেন। আবাহন মন্ত্রটি হল—
ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।
সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলায় বলবেন, এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি স্থির হয়ে থাকো মা।তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা।এরপর আপনার পূজাদ্রব্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার গৃহে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি জল ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন।
এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন। এটি হল অর্ঘ্য। এর সঙ্গে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি নিবেদন করে দেবেন।
তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। মন্ত্র—এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি ওঁ শ্রীঁ লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ। (শ্রীঁ উচ্চারণ হবে শ্রীং, নমঃ উচ্চারণ হবে নমহ।) পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন। পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে দেবেন। তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে দেবেন। মা লক্ষ্মীর পেচককেও একটি ফুল দেবেন। আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে প্রণাম করবেন—
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে ।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে ।।
মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর ব্রতকথা পাঠ করবেন বা শুনবেন।বিঃ দ্রঃ কেউ কেউ লক্ষ্মীকে পান-সুপারিও দেন। আপনাদের বাড়িতে তেমন প্রথা থাকলে দেবেন।বাড়িতে যে লক্ষ্মীর পাঁচালি আছে সেটিই পড়বেন। লক্ষ্মীর ব্রতকথা বা পাঁচালি বাজারে সুলভ। বাড়িতে পাঁচালি না থাকলে, যেকোনো একটি কিনে নিয়ে পাঠ করলেই চলে।
বেশিরভাগ অঞ্চলে শুক্রবার মহালক্ষ্মীর উপবাস রাখা হয় ও বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ওদিকে বাংলার ঘরে ঘরে বৃহস্পতিবারই লক্ষ্মীবার। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো দক্ষিণ ভারত ও পূর্ব ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও উত্তর ও পশ্চিম-ভারতে মা লক্ষ্মীর আবাহন মূলত হয় ধনতেরাস-দিওয়ালি তিথিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বছরে মাত্র একটি বা দু'টি দিন নয়, শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন যে ধারাবাহিকভাবে, যদি সারা বছরই কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করা যায় এবং ভক্তিভরে কিছু নির্দিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ করা যায়, তবে তাঁর কৃপালাভের পথ সুগম হয়।