হিন্দু ধর্মে তুলসী দেবীর মাহাত্ম্য ও পূজার্চনা

হিন্দু ধর্মে তুলসী দেবীর মাহাত্ম্য ও পূজার্চনা

হিন্দু ধর্মে তুলসীর বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। বিভিন্ন পূজার্চনা ও শুভ কাজ তুলসী ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। তবে গণেশ ও শিবের পুজোয় তুলসী বর্জিত। শাস্ত্র মতে প্রতিদিন তুলসীর দর্শন করলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার তুলসী পুজোকে মোক্ষদায়ক মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মে দেব পুজো ও শ্রাদ্ধ কর্মে তুলসী পাতা অপরিহার্য। শাস্ত্র মতে তুলসী পাতা দিয়ে পুজো করলে ব্রত, যজ্ঞ, জপ করার মতো পুণ্য লাভ করা যায়।

তুলসী দেবী শ্রীকৃষ্ণ প্রিয়া শ্রীরাধিকার সহচরী ছিলেন।একদিন গোলকে (স্বর্গে) তুলসীকে কৃষ্ণের সঙ্গে ক্রীড়ারত দেখে রাধিকা একে অভিশাপ দেন যে তুমি মানবী রূপে জন্মগ্রহণ করবে। এতে কৃষ্ণ দু:খিত হয়ে তুলসীকে সান্তনা দিয়ে বলেন, মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করলেও তপস্যা দ্বারা অামার একঅংশ প্রাপ্ত হবে। শ্রীরাধিকার শাপে তুলসী পৃথিবীতে রাজা ধর্মধ্বজের ও মাধবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে তুলসী (মতান্তরে বৃন্দা) নামে অভিহিত হন। অত:পর তুলসী বনগমণ করে শ্রীব্রহ্মার কঠোর তপস্যায় আত্মনিয়োগ করেন,তার কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মা স্থির থাকতে না পেরে তাকে বর দিতে সম্মত হন।

দেবী তুলসী বলেন তিনি নারায়ণকে স্বামীরূপে কামনা করেন। ব্রহ্মা বলেন এখন তুমি কৃষ্ণের অংশ সুদামের স্ত্রী হও। পরে কৃষ্ণকে লাভ করবে। রাধিকার শাপে সুদাম দানবরূপে জন্মগ্রহণ করবে, তার নাম হবে শঙ্খচূড়। নারায়ণেরর শাপে তুলসী বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করবে। তুমি না জন্মগ্রহণ করলে তার সকল পূজা ব্যর্থ হবে। যথা সময়ে শঙ্খচূড়ের সঙ্গে রাজা ধর্ম ধর্ব্বজের কন্যা তুলসীর বিবাহ হয়। পরবর্তী জন্মে তিনি শঙ্খচূড়ের (মতান্তরে জলন্ধর) পত্নী হন,যিনি গোলকবৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ প্রকাশ সুদাম সখা রূপে বিদ্যমান। শ্রীকৃষ্ণ এর ইচ্ছায় রাধারাণীর অভিশাপে তিনি শ্রীকৃষ্ণ এর অংশ সুদামা শঙ্খচুড় (মতান্তরে জলন্ধর) রূপে মর্ত্যে জন্ম গ্রহণ করেন।

শঙ্খচূড় শিবের কাছ থেকে বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, তার স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট হলেই তার মৃত্যু হবে। শঙ্খচূড়ের উৎপাত ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে শ্রীব্রহ্মার সহিত শিবের নিকট গিয়ে উপস্হিত হন। এরপর দেবতা দের অজেয় শঙ্খচূড় এর সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধ শুরু হয়। তখন দেবতাদের প্রার্থনায় ভগবান শ্রীবিষ্ণু শঙ্খচূড়ের ছদ্মবেশে তুলসী দেবী কে তার পূর্বকৃত তপস্যার ফল দান করলেন তথা পতি সঙ্গ দান করেন; ফলে শঙ্খচূড় নিহত হন।

দেবী তুলসী (মতান্তরে বৃন্দা) যদিও পূর্ববর্তী জন্মে ভগবান কে পতি রূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন, তবুও সেসময় তার বর্তমান পতি বিয়োগ ও বিষ্ণুর এ আপাত ছলনা সইতে না পেরে তিনি তখন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ক্রোধ সংবরন করতে না পেরে তিনি বিষ্ণুর এ আচরণের জন্য পাষান হৃদয় বিবেচনা করে তাঁকে শিলামূর্তি হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন,তৎক্ষণাৎ দেহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।পরে তুলসী তার ভুল বুঝতে পারেন যে ,তিনি ভগবান এর প্রতি অভিশম্পাত করেছেন। তখন ভগবান ও তুলসী কে বর দান করেন।

শ্রী বিষ্ণুর বরে সাধ্বী তুলসী দেহত্যাগ এর পর দিব্য দেহ ধারণ পূর্বক গোলকে শ্রীকৃষ্ণ কে পতিরূপে প্রাপ্ত হন ; তাঁর শরীর ভারতে গণ্ডকী নামে প্রসিদ্ধা, মনুষ্য গনের পুন্য প্রদা পবিত্রতার নদী রূপে পরিণত হয় এবং তাঁর কেশকলাপ তুলসী কেশসম্ভুতা বলে তুলসী নামে বিখ্যাত পবিত্র বৃক্ষ রূপ ধারণ করেন। শ্রী বিষ্ণু বলেন- “হে সাধ্বী সুন্দর স্বর্গ ,মর্ত্য ,পাতাল,বৈকুণ্ঠ ও আমার সন্নিধ্যানে তুলসীবৃক্ষ সমুদয় পুষ্প হতে শ্রেষ্ঠ হবে।তুলসী তরুমুলে সমুদয় তীর্থের অধ্ষ্টান থাকবে। যে নর তুলসী কাষ্ঠ নির্মিত মালা ধারণ , করবেন তার পদে পদে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হবে”। এদিকে শিব শূল দ্বারা শঙ্খচূড়ের অস্থি সমূহ লবণ সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন এবং সেই অস্থি সমূহ হতেই নানা প্রকার শঙ্খের উৎপত্তি।।। যে স্থানে শঙ্খ ,সে স্থানে লক্ষী সহ শ্রীহরি বিদ্যমান থাকেন। (সূত্র:- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড- ২০ এবং ২১ তম অধ্যায়)

তুলসী দেবীর কৃপা ব্যতীত কৃষ্ণ প্রেম সম্ভব নয়। তাই তুলসী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য নিয়মিত তুলসী সেবা আবশ্যক। কৃষ্ণ সেবায় একমাত্র তুলসী পত্র ব্যতীত অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। তুলসী দেবী কৃষ্ণভক্তি লাভের প্রতীক। এছাড়াও তুলসী পত্র একটি মহাঔষধি। 

সর্বৌষধি রসেনৈব পূর্বমৃত মন্থনে।
সর্বোসত্ত্বোপকারায় বিষ্ণুনা তুলসী কৃতা।।
(তথাহি স্কন্ধ পুরাণ)
পরাকালে দেবাসুর হইয়া মিলিত।
সমুদ্র মন্থনে করে উৎপন্ন অমৃত।।
জীবের মঙ্গল হেতু বিষ্ণু হিতময়।
সর্বগুণা তুলসীরে উদ্ধত করয়।।

তুলসী মাহাত্ম্যঃ
ন বিপ্রসদৃশং পাত্র ন দানং সুরভে সমম্‌।
ন চ গঙ্গাসমং তীর্থং ন পত্রং তুলসী সমম্‌।।
অভিন্ন পত্রং হরিতাং হৃদ্যমঞ্জরী সংযুতাম্‌।
ক্ষীরোদার্ণব সম্ভুতাং তুলসী আপদোদ্ধার।।
(তথাহি স্কন্ধ পুরাণ)
ব্রাহ্মণ সমান পাত্র ধেনুতুল্য দান।
ধরাধামে তীর্থ নাহি গঙ্গার সমান।।
তেমনি পত্রের মধ্যে হয় শ্রেষ্ঠ তরা।
তুলসী নামেতে পত্র খ্যাত এই ধরা।।
যে তুলসী সমুদ্ভব ক্ষীরোদ সাগরে।
অচ্ছিন্ন হরিৎ পদ্ম কৃষ্ণ দান করে।।
ক্ষীরোদ সাগরে জন্ম তুলসী হরিৎ।
অচ্ছিন্ন মঞ্জুরী কৃষ্ণে হলে সমর্পিত।।
সকল আপদ নাশি মুক্ত হয় সেই।
ছিন্ন ভিন্ন পক্কপত্র তুলসী না দেই।।

তুলসী জাগরণ মন্ত্রঃ
উত্তিষ্টং তুলসীদেবী গাত্রোত্থানাং কুরু যথা।
অরুণোদয় প্রাতঃ প্রীচরণে প্রণমাম্যহম্‌।।

তুলসীর মূল লেপন মন্ত্রঃ
তুলসী নিপয়তে গঙ্গা স্থানেমেকং বারাণসী।
সেবনে পঞ্চতীর্থানি তুলসীভ্যাং নমো নমঃ।।
তুলসী ত্বং সদা ভক্তা সর্বতীর্থফলং ভবেৎ।
লেপনাৎ তব মূলঃ সর্বপাপৈ প্রমুচ্যতে।।
তন্মুলে সর্বতীর্থানি তৎপত্রে সর্বদেবতা।
তদঙ্গে সর্বপুণ্যানি কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীং।।

তুলসী স্নান মন্ত্রঃ
গোবিন্দবল্লভাং দেবী ভক্তচৈতন্যকরণীং।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীং।।

তুলসী চয়ন মন্ত্রঃ
তুলস্যমৃত নামাসি সদা ত্বং কেশব প্রিয়া।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে।।
তদঙ্গ সম্ভবৈ পত্রৈ পূজয়ামি যথা হরিং।
তথা কুরু পবিত্রাঙ্গি, কলৌমলবিনাশিনীম্‌।।
চয়ানাদ্ভব দুঃখান্তে যদ্দেবি। হৃদি বর্ততে।
তৎ ক্ষমস্ব জগন্মাতস্তুলসী! ত্বাং নমাম্যহম্‌।।

তুলসী অর্ঘ্য মন্ত্রঃ
শ্রিয়ঃ শ্রিয়ে শ্রিয়াবাসে নিত্যং শ্রীধরসৎকৃতে।
ভক্ত্যা দত্তং ময়া দেবী গ্রহাণার্ঘ্যঃ নমোহস্তুতে।।

গন্ধ পুষ্প দেওয়ার মন্ত্রঃ
ইদং গন্ধং তুলসীদেব্যৈ নমঃ।
এতে গন্ধপুষ্পে তুলসীদেব্যৈ নমঃ।।

পূজান্তে পাঠ্যঃ
নির্মিতা ত্বং পুরা দেবৈ রচিতা ত্বং সুরাসুরৈঃ।
তুলসী হর মে পাপং পূজাং গৃহ্ন নমোহস্তুতে।।

তুলসীর স্তুতিঃ
মহাপ্রসাদ জননী সর্বসৌভাগ্যবর্ধিনী।
আধিব্যাধিহরি নিত্যং তুলসী ত্বং নমোহস্তুতে।।

তুলসীর ধ্যানঃ
তুলসী সর্বভূতানাং মহাপাতকনাশিনী।
স্বর্গাপবর্গদে দেবী বৈষ্ণবানাং প্রিয়ে সদা।।
সত্যে সত্যবতীচৈব ত্রেতায়াং মানবী তথা।
দ্বাপরে অবতীর্ণাসি বৃন্দা ত্বং তুলসী কলৌ।।

তুলসীর প্রণামঃ
বৃন্দায়ৈ তুলসীদেব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ।
কৃষ্ণভক্তিপদে দেবী সত্যবত্যৈ নমো নমঃ।।
যা দৃষ্টা নিখিলাঘ সঙ্খ সমমী স্পষ্টা বপুঃ পাবনী।
রোগানামভিবন্দিতা নিরসনী সিক্তান্তকত্রাসিনী।।
প্রত্যাশক্তি বিধায়িনী ভগতবঃ কৃষ্ণস্য সংরোপিতা।
ন্যস্তাতচ্চরণে বিমুক্তি ফলদাতস্যৈ তুলস্যৈ নমঃ।।

তুলসী চয়ন নিষিদ্ধ তত্ত্বঃ
অস্বাতা তুলসীং ছিত্বা যঃ পূজা কুরুতে নরঃ।
সোহপরাধা ভবেৎ সত্যং তৎসর্ব নিষ্ফলঃ ভবেৎ।।
ন স্নাতা তুলসীং ছিদ্যাং দেবার্থে পিতৃকর্মণি।
মাসান্তে পক্ষয়োবন্তে দ্বাদশ্রাং নিশি সন্ধ্যয়োঃ।।
তুলসীচ্ছেদনেব বিষ্ণোঃ শিরসি ছেদনম্‌।
বিনা স্নানে করে যদি তুলসী চয়ন।
তাহা দ্বারা করে যদি ভগবৎ অর্চন।
দেবকর্ম পিতৃকর্ম বিফলে তার যায়।
পদ্মপূরাণের মতে বর্ণিলাম তায়।।
দ্বাদশী, সংক্রান্তি, সন্ধ্যা, অমা পৌর্ণমাসী।
রাত্রি কালে কখন না তুলিবে তুলসী।।
যদিস্যাৎ কোন লোক করয়ে চয়ন।
বিষ্ণু শিরচ্ছেদ পাপ হইবে তখন।।

তুলসী আরতিঃ
নমো নমো তুলসী শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী
জয় রাধাকৃষ্ণের চরণ পাব এই অভিলাষী।।
যে তোমার স্মরণ লয়…. তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়
তুমি কৃপা করি কর তারে বৃন্দাবনবাসী।
এই মনের অভিলাষ …. বিলাস কুঞ্জে দিও বাস
নয়নে হেরিব সদা যুগলরূপ রাশি।।
এই নিবেদন ধর…. সখীর অনুগত কর
সেবা অধিকার দিয়ে কর নিজো দাসী।।
তুমি বৃন্দে নাম ধর…. অঘটন ঘটাতে পার
কৃপা করি সিদ্ধমন্ত্র দিলা পৌর্ণমাসী।।
দীন কৃষ্ণদাসে কয়…. মোর যেন এই হয়
শ্রীরাধা-গোবিন্দ প্রেমে সদা যেন ভাঁসি।।

তুলসী প্রদক্ষিণ মন্ত্রঃ
যানি কানি চ পাপানি, ব্রহ্মহত্যাদি কানি চ।
তৎ সর্ব্বং বিলয়ং যাতি, তুলসী! তৎপ্রদক্ষিণাৎ।।(দুই বার)

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

প্রতিদিন তুলসীর পুজো করলে বাড়িতে ধন-সম্পদ, বৈভব, সুখ-সমৃদ্ধির আগমন ঘটে। আবার প্রতিদিন তুলসীর সামনে মনস্কামনা ব্যক্ত করলে তা পূর্ণ হয়।  

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা